আমার এক বন্ধুর মুখে নোয়াখালী-কে 'নিউক্যালি' ছাড়া কখনো  বলতে শুনি নি । তার উচ্চারণ শুনলে তাকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা ভেবে ভুল হয় ! শব্দের এমন যুতসই সমন্বয়  যার মাথা থেকেই প্রথম আসুক -  বেচারা যে সৃষ্টিশীল রসিক নোয়াখাইল্যা সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই । তাছাড়া কেউ আই(আমি), হানি(পানি) - এসব আঞ্চলিক শব্দের জন্য আমেরিকান ভাব মারলে তাকে দোষ দেয়া যায় না - ভাবটা যৌক্তিকও বটে ! তবে চিটাগাইংগ্যারা তাদের চ্যালেঞ্জ করার যোগ্যতা রাখে – কারণ ইংরেজী ব্যাকরণ যে তাদের পক্ষে ! ইংরেজিতে ক্রিয়া নির্দেশক পূর্বে বসে – I don’t know; এই রীতি চিটাগাইংগ্যারা হুবহু মেনে চলে - ‘আঁই ন জানি’ ! তবে আধুনিকের চেয়েও এক কাঠি সরেস নিঃসন্দেহে ঢাকাইয়্যারা । উত্তর আধুনিক আঞ্চলিকতায়  ইংরেজি শব্দ নিয়ে রীতিমত গবেষণা চলে ঢাকার সর্বত্র । সম্প্রতি অতি প্রচলিত দু'একখান উদাহরণ দেই - What say you ? Are you game ?
    একটা প্রবাদ আছে - 'যস্মিন দেশে যদাচার - কাছা খুলে নদী পার' । আঞ্চলিকতার এসব 'শর্টকাট মেথড' কাশীতে ভূমিকম্পের মত লোকমুখে ছড়ায় । 'কথা কইলে ব্যথা সারে' বলে' এসব আঞ্চলিকতায় ভুলের ঢোল পেটানোতে খারাপ কিছু দেখি না । কিন্ত থুঁতির জুড়ে 'বুলের ঢোল' না ফাটলেই রক্ষে ! গাছের শত্রু লতা আর মানুশের শত্রু তো কথাই !
                                কথার সূতা এতই পেঁচানো যে - আঞ্চলিক গণ্ডি ছাড়িয়ে তা মারপ্যাঁচে 'পদ্মা বহুমুখী সেতু'র উপর সমন্বয়ের অভাবে হিমশিম খাচ্ছে নদীর আন্তর্জাতিক ঘোলা জলে ।  চীনা প্রকৌশলীর সাথে বাঙালি শ্রমিকদের 'কইতেও পারি না-সইতেও পারি না' - এমন পরিস্থিতি নিত্য ঘটনা । চৈনিক শিক্ষিতদের ইংরেজির দৌড় আপ-ডাউন, সাম-সাম, ইয়েস-নো পর্যন্ত । তবে এদের কাজের দৌড় এত প্রবল যে বাঙালি শ্রমিক কিছু বুঝুক আর না-বুঝুক এটা বুঝে যে কাজ করতে হবে । ইদানীং এসব চীনারাও ইংরেজির চেয়ে বাংলাই এখন ভাল পারে -  ভাত,পানি,ঠিক আছে, চালু চালু কাজ -  এসব কথার রেকরডিং তারা  ভালই দিনভর বাঁজায়।
      বাঙালি দোভাষীদের অবস্থাও সর্বত্র তথৈবচ ! একটা উদাহরণ দেই -
ভিনদেশী - 'প্লিজ টেল হিম নট টু টেল আননেসসারি লাইজ'
দোভাষী - শুধুমাত্র দরকার হলে মিথ্যে বলবেন (টেল লাইজ অনলি হয়েন নেসসারি)
মুখের কথা বাদ দিয়ে লিখার খাতায় আসা যাক । 'এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে ৫০টাকা জরিমানা' - এমন যতি ভুলে মতিছিন্নের হাজার উদাহরণ আছে ।  সেসব যদি আদারব্যাপারীর খবর হয়; তবে রীতিমত শিক্ষিত-সুশীল-নেতা-কর্তাদের সুকুমার বৃত্তি নিয়েও কিছু কথা বলতেই হয় ।  'গোগল ট্রান্সলেটর' নামক প্রহসন যন্ত্রে সার্চ দিলে বাংলাদেশের শিক্ষার আদ্যপান্তু ভূগোল সহজেই বুঝা যায় ! বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর নিষ্ঠার ফলাফল সার্চ দিলে কী হয় তার কয়েকটা উদাহরণ এমন -
খালেদা-Outdoor ;  হাসিনা-Returns ; সুরঞ্জিত-Acting ; বঙ্গবন্ধু-CIT ;  তারেক-Fabric ;  ছাত্রলীগ-YesNo
      ভাষা নিয়ে এমন গবেষণা বাংলার বুকে কম হয় নি । চেয়ারের নাম কেদারা ধোপে টিকে নি । বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় টিকে গেলেও জোর করেও কলেজের নাম মহাবিদ্যালয় বলে চালানো যায় নি । বিজ্ঞানে অজ্ঞ বাঙালি যে চেষ্টা করেও তাল বেশিদিন রাখতে পারবে না - তা বোধগম্য ছিল । তাও অক্সিজেন-হাইড্রোজেন কে অম্লজান-উদজান বানানোর চেষ্টা হয়েছিল । পারলে ফ্লপিডিস্ক-কে লটরপটর চাকতি বানানো হয় ! অণু-পরমাণু পর্যন্ত দখল হলেও ইলেকট্রন-প্রোটন নিয়ে পাণ্ডিত্য জাহিরের চেষ্টা করার মত যোগ্য কুপন্ডিতও এদেশে নেই ! কারণ বিজ্ঞানে বেশি রাজনীতি করা যায় না । ভাষা নিয়ে যত বাড়াবাড়ি হয়েছে তার ষোলআনাই রাজনৈতিক অপউদ্দেশ্যে - আর এর সিংহভাগই ধর্মের দোহাই দিয়ে । ১৯৯১ সালে চিটাগাং এ সাইক্লোনের পর বিটিভিতে এক আলোচনায় জলোচ্ছ্বাস-কে পানিচ্ছাস বলে সম্বোধন করেছিলেন এক সুশীল আলোচক; কারণ জল আর পানির মারামারি ! টক-শো এর নাম বদলিয়ে 'বক বক অনুষ্ঠান' রাখলে এটা নিশ্চিতভাবে টিকত বলেই বোধ করি । পাকিস্তান আমলে যা হয়েছে তা কৌতুককেও হার মানায় । বিখ্যাত কবিতাগুলোর খতনা দিয়ে মুসলমানি চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে - ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ – এটি হলো, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি’। জসিমুদ্দিনের 'নিমন্ত্রণ' কবিতার নাম হয় 'দাওয়াত'; কায়কোবাদের 'মহাশ্মশান' এর নাম হয় 'গোরস্থান' । হিন্দুবাদী চেষ্টাও কম হয় নি - স্বয়ং রবীবাবু(পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি) নজরুলকে উদ্দশ্য করে 'খুন' শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুললে নজরুল উপযুক্ত জবাব দেন 'বড়র পিরীত বালির বাধ' লিখে । এ যুগেও 'জিম্মা' কিংবা আরও কিছু শব্দ বাংলা নয় বলে মাঝে মাঝে যে গীত উঠে তাতে গানের কথা অনেকাংশে সঠিক হলেও উদ্দেশ্য যে মহৎ নয় তা স্পষ্টই বুঝা যায় । মোল্লার মসজিদ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি বা কালীর দোহাই দিয়ে পাঠা খাওয়ার দৃশ্য এখনো নিত্যনতুন মোড়কে বাংলা ভাষার বিজ্ঞাপন প্রচার করে, নিয়ন্ত্রন করে । 'গরু-পাঁঠা বিতর্ক' ভাষায় যেন না ঢোকে সেটাই কাম্য ।
       কথায় কথা বাড়লে সমস্যা নেই - তবে কথা যখন মানুষের চিন্তার বিকাশেও প্রভাব রাখে, তখন 'শব্দ-ভাষা'কে তাচ্ছিল্য করে বাংলার আত্মাকে 'গোগল ট্রান্সলেট' এর মত হত্যা করে ভূত বানানো একরকম অপরাধ । একেকটি শব্দ একেকটি স্মৃতি-ঘটনাকে যেমন সংরক্ষণ করে রাখে, তেমনি একটি নাম- একটি শব্দ অনেক গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণের উপাত্তও ধারণ করে । অথচ আজকাল  ভাত খেলেও মজা লাগে, রেজাল্ট ভাল হলেও মজা পাই আর নাটক দেখলেও মজাই লাগে ! আলাদা আলাদা শব্দে গভীর করে অনুভূতি ধারণের প্রয়োজন কেউ বুঝি না ।
           আরও কিছু সমস্যার কথা বলি । শামসুল হকের একটা লিখায় পড়েছিলাম -  কিছু কিছু অতি সাহিত্যিক আছেন - নিজেকে 'দ্রোহী' বলেও দাবী করেন ; অথচ জানেন না 'দ্রোহী' শব্দের মানে হল প্রতিহিংসা বা অন্যায় ভাবে প্রতিশোধ নেয়া । বিদ্রোহী শব্দটি দ্রোহীর সম্পূর্ণ বিপরীত - বিদ্রোহ অর্থ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । এমন গোঁয়ার চেনা যায় কর্কশ বচনে ! বাঁশ মরে ফুলে মানুশ মরে বুলে - এই কথা ভুলে গিয়ে বাড়াবাড়ি করলে 'অতি কথনে ক্ষেতা হারানো' সময়ের ব্যাপার । শামসুল হক সাহেব 'ভালবাসা'র বদলে ' 'ভালোবাসা' লিখতে পছন্দ করেন, আমি বা আরও অনেকেই সেটা পছন্দ করি । ভালোবাসা তাতে একটু যেন বেশি-ই প্রকাশ পায় । শব্দের শবযাত্রায় এসবতো এখন সৌখিনতাই মনে হয় ! সম্ভবত প্রমথ চৌধুরী একবার 'বউ' শব্দটির বেলায় বলেছিলেন - বউ- এর মাথায় ঘোমটা কই ? ঘোমটা বলতে ৌ -সহ 'বৌ'কে তাঁর বাঙালি বৌ বলে মনে হয়েছিল । অতি সহজীকরণ বা অতিজটিলতা দুটাই ধ্বংসাত্মক; সুধীজনেরা উপযুক্ত নির্দেশনা দিবেন বলেই আশাবাদী ।
     ভাষা বাঙ্গালীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য । তাই ভাষা জানা উচিত সামাজিক-ব্যক্তিগত উভয় স্বার্থেই । বাচ্চাদের শেখানো হয় 'অ' তে অজগর, ক- তে কাক । এতে বাচ্চারা বাস্তবিকই তোতা পাখি হয়ে মেধাকে ভোঁতা করে শিক্ষাজীবন শুরু করে । কল্পনা করার সীমানা একটা কাক বা অজগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায় । অথচ কাক বা অজগরের সাথে কিছু 'ইমেজ' যোগ করে  পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে মানানসই কোন পূর্ণ চিত্র তৈরি করতে পারলে বাচ্চারা যুক্তি আর কল্পনার সমন্বয়ে সৃষ্টিশীলতার অভ্যাস রপ্ত করতে পারতো ছোটবেলা থেকেই । বাচ্চাদের দিকে দৃষ্টি না দিলে দৃশ্যপট কোনকালেই বদলাবে না ।