আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আগের লেখাগুলোতে কবিতাসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলাম । ‍আজ আমি কবিতার ভাষা ও চিত্রকল্প সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করব।


অনেক কবিই একমত হবেন যে বুদ্ধি বা হৃদয় অপেক্ষা শক্তিশালী কল্পনা, ভাববিলাসিতা বা চিত্রকল্প কবিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপজীব্য । বলিষ্ঠ কবিতার ক্ষেত্রে ভাবানুভূতি তীব্রভাবে কাজ করে থাকে । গোধূলির সৌন্দর্য, দিগন্তের বিস্তৃতি, আকাশের উদারতা বা ব্যাপকতা, মহাসমুদ্রের বিশালত‍া, শরতের শুভ্র আকাশ, বৃষ্টির সুর যোজনা, হেমন্তের সোনালী ধান, বসন্তের বাহারি রঙ, নিসর্গের অকৃত্রিম শোভা কিংবা নির্যাতিতের অসহায় কান্না, স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ কষ্ট, শক্তিমানের ক্ষমতার দর্প, জালিমের অমানবিকতা, অল্প কথায় সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা, বিষাদ ইত্যাদির অনুভূতি একজন কবিকে কল্পলোকের বিচিত্র আঙিনাতে বিচরণ করতে সাহায্য করে । সার্থক কবি সবসময় প্রচন্ড কল্পনাবিলাসী হন, আর এ কল্পনাবলেই কালোত্তীর্ণ কবিতা লেখা সম্ভব হয় । আসলে বিষয়বস্তু উপস্থাপনে যতো অপরূপ অনুপম রূপাচ্ছাদন করা যায় কবিতা ততো মোহনীয় কাব্যময় হয় । কেবল প্রখর কল্পনাশক্তির মাধ্যমেই রূপবত্তা ঠিক রেখে কবিতাকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় । এরূপ উপস্থাপনে কবিতার সৌন্দর্য নিহিত থাকে ।


কবিতার ক্ষেত্রে কেউ কেউ শুধুমাত্র বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে ভাষা ও বিষয়বস্তু দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ, না হলে কবিতার গঠন ও সৌন্দর্য দুর্বল হয়ে পড়ে । কবিতা লেখার ক্ষেত্রে থাকতে হবে চিত্তের শুদ্ধতা-সততা, নিতে হবে ভাব ও ভাষার আশ্রয় । কবিতা অলংকারহীন শুধুমাত্র শব্দাশ্রয়ী হলে, তা কিছুটা সাদাসিধে বা নিরাভরণ মনে হয় । বিশেষ করে আধুনিক কবিতায় পাঠক একটি ন্যুনতম চিত্রকল্প আশা করেন । কবিতা যদি শব্দের ব্যঞ্জনামথিত চিত্রকল্পের পাশাপাশি ছন্দাশ্রয়ী হয় তবে সে কবিতা সময়কে ধারণ করে ছুটে চলে অসীমের পথে ।


অনেক কবিতা গদ্যনির্ভর হলেও এর অন্তরমিলবিহীন একটা ছন্দ রয়েছে, কবিতার প্রবাহমানতা এর ছন্দ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তক ছন্দ ও গদ্য ছন্দের আলোকে বাংলা ভাষাকে এক ভিন্ন মাত্রা দেন । গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের সময় তিনি অন্তমিলের বদলে মুক্ত ছন্দ ব্যবহার করেন । এখান থেকে তিনি গদ্য ছন্দ লিখতে অনুপ্রাণিত হন । গদ্য ছন্দে পর্ব সৃষ্টিতে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে, যতিনির্ভর হওয়ায় গদ্য ছন্দের পর্বকে ধ্বনিপর্ব বলা হয় । এক্ষেত্রে আবেগ ও ভাবের উপর নির্ভর করে পর্ব তৈরী হয়, এজন্য একে অর্থপর্ব বা ভাবপর্বও বলা হয়ে থাকে ।


কবিতার প্রমূর্ত ভাবটাই শুধু কবিতা নয়, এর একটা অনুক্ত বক্তব্য থাকে যা আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য। ফলে কবিতায় শব্দের প্রয়োগের চেয়েও শব্দের অর্থব্যঞ্জনার মূল্য অনেক বেশি । ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবি যথেষ্ট স্বাধীন । তবে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব গুরুচন্ডালী রোগ পরিহার করা উচিৎ। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কবিতার ছন্দ ও ভাব-মাধুর্য্যের অপরিহার্যতার কারণে সাধু চলিতের মিশ্রণ মেনে নেয়া হয় । সর্বোপরি, কবিতা হতে পারে প্রতিকাশ্রয়ী, রূপকাশ্রয়ী, ধ্বনিবহুল, চিত্রবহুল ।  


এবার কবিতার চিত্রকল্পের বিষয়ে আসা যাক । বহু কবিতা চিত্রকল্প ছাড়াও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তাই কবিতায় চিত্রকল্প আবশ্যিক নয় । তবে আধুনিক কবি ও সমালোচকবৃন্দ কবিতার চিত্রকল্পকে শুধু গুরুত্বপূর্ণই মনে করেন না আবিশ্যিকও মনে করেন । আসলে চিত্রকল্প কি ? সাধারণভাবে কবির কল্পনা বা ভাবানুভূতির চিত্রকে শব্দবিন্যাসের মাধ্যমে বিভিন্ন প্যাটার্ন বা আকারে উপস্থাপন করাই হলো কবিতার চিত্রকল্প । কবিতায় কবির উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে কখনো সংহতি, কখনো ব্যপ্তি ও বৈচিত্র দানের প্রয়োজনেই চিত্রকল্পের জন্ম । চিত্রকল্প বিচ্ছিন্নভাবে কবিতা নয় বটে, কিন্তু কবিতার খুবই দরকারি উপাদান । ইংরেজি ভাষার ‘ইমেজ’ ও বাংলা ভাষার ‘বাক-প্রতিমা’ কথাটি চিত্রকল্পের সমার্থক হতে পারে। কবিতায় চিত্রকল্প কবির ‍আত্মার গূঢ় সংকেতনির্ভর, এক্ষেত্রে অলংকার বা তুলনার কারুকাজে এক চিত্র হতে দূরের নিগূঢ় আরেকটি চিত্র পরিস্ফুট হতে পারে কবিতায় । তাই বলা যায় উপমা একটি গুণ বা শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট, আর চিত্রকল্প সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু বা অভিজ্ঞতাকে নিয়ে কাজ করে । এ চিত্রকল্প প্রত্যক্ষ হতে পারে বা পরোক্ষ হতে পারে। উপমা-উৎপ্রেক্ষার সম্মিলনে গড়ে ওঠে প্রত্যক্ষ চিত্রকল্প, আর সে চিত্রকল্প কবিতার ভিতরে লুকায়িত থাকে এবং পাঠক তার উপলব্ধি করে পুলকিত হয়ে থাকেন সেটাই পরোক্ষ চিত্রকল্প । সুতারং, বলা যায় সার্থক কবিতায় উপমা-উপ্রেৎক্ষার মাধ্যমে চিত্রকল্প গড়ে উঠতে পারে, আবার কবিতায় কবি যা প্রকাশ করেন তার বাইরে অনুক্ত কথার মাধ্যেমেও চিত্রকল্প গড়ে উঠতে পারে ।


পরিশেষে বলতে হয়, সময়ের সাথে সাথে কবিতার আঙ্গিকের বদল হবে, শব্দ, ছন্দ, চিত্রকল্পের ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটবে । কবিতার এই বাক পরিবর্তনকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহন করে এমন কিছু সৃষ্টি করতে হবে যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও কালজয়ী হয় ।