জাগরনের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,


এই শিকল পরা ছল
মোদের এই শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই
শিকল তোদের করবো রে বিকল।


অথবা সেক্সপিয়ারের কথাই ধরুন, একজন উপনিবেশবাদী মনিবের প্রতি দ্রোহের উক্তি,


তুমি আমাকে ভাষা শিখিয়েছ
আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম


কবিতার বিবিধ পাখা, সুদুর অতীত হতে মানুষ কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে তার ভাবনা, উপলব্ধি, বোধ, বিশ্বাস, ক্ষোভ, দ্রোহ, ভালোবাসা, বিরহ, স্বপ্ন ইত্যাদি শিল্পসমৃদ্ধ ছন্দ ও ভাষায় প্রকাশ করে আসছে। কবিতা সুন্দরের পুজারী, দূর করে মনের কলুষতা, স্বপ্নের সভ্যতার পথের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। আবার, যেখানে অন্যায় অসংগতি কবিতা সেখানে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, বর্ণে বর্ণে ওঠে প্রতিবাদী বিদ্রোহী সুর। একটি সুস্থ সু্ন্দর সমাজ কবিদের প্রত্যাশা।  


বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে যুগে যুগে বিভিন্ন কবি তাদের কবিতায় প্রতীকী, শৈল্পিক নৈপুণ্য ও ভাষার আলঙ্কারিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে প্রতিবাদ-বিদ্রোহ ছড়িয়ে গেছেন, তবে তা বুদ্ধিজীবি-পাঠকশ্রেণী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে, অতি সাধারণ পাঠকের কাছে যেতে পারেনি। ব্যতিক্রম শুধু নজরুলের বিদ্রোহ, যা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, খরস্রোতা নদীর মতো সাধারণ ভাষা, অতি পরিচিত চিত্রকল্প, ফলে অল্পশিক্ষিত জনতাও তা সহজে বুঝতে পারতো এবং পাঠক তাঁর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতো। এজন্য তাঁর এতো জনপ্রিয়তা।


কবিকে জানতে হবে কবিতার ভাষাকে কখন কোন প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। সাহিত্যে দ্রোহ, সেটা উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক কিংবা কবিতাই হোক একালের বিশ্বসাহিত্যে অনেক বেশি আদৃত। অসহ্য যান্ত্রিকতায় পুঁজির মহিষ দাবড়ানি, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, যুদ্ধ, অমানবিকতা, ক্ষুধা, হিংস্রতা ইত্যাদি অনাচার ও অসংগতির নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে আকাশে বাতাসে শুধু হাহাকার। এমনি প্রেক্ষাপটে ভাববাদী রোমান্টিক যুগের কাব্য অপেক্ষা কবিতায় মানবতার ফরিয়াদ বড় প্রয়োজন। এর অর্থ এই নয় যে কবিতা থেকে ভাববাদী রোমান্টিকতা বিসর্জন দিতে হবে। তবে, সমকালীন প্রেক্ষাপটে মানুষের আত্মার সঙ্গী এখন বিপ্লবী ও সংগ্রামী ভাবনা।


তাইতো কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ‘লাশ’ কবিতায় বলেছিলেন,


যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে ধরণীর ‘পর,


এখানে কবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা ছাড়া পাঠকের উপায় থাকে না।


কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে-দিনের কবিতায়’ আসা যাক,


প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।


কঠিন বাস্তবতায় তখন রোমান্টিকতা হারিয়ে যায়, তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুধার্ত আত্মভোলা মানুষগুলোর চোখে তখন জ্বলে ওঠে বিপ্লবের বারুদ।


অথবা প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ-এর ‘পরিচয়পত্র’ কি বলে,


লিখে রাখো!
আমি একজন আরব
এবং আমার পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটি সন্তান
আর নবমটি পৃথিবীতে আসবে গ্রীষ্মকালের পর
তোমরা কি ক্ষুব্ধ হবে তাতে?


অতএব !
প্রথম পাতার শীর্ষে লিখে রাখো:
আমি ঘৃণা করি না মানুষকে
অথবা দখল করি না অন্যের জমি
কিন্তু যখন আমি ক্ষুধার্ত তখন
জবরদখলকারীর মাংস হয় আমার খাবার
সাবধান…
সাবধান…
আমার ক্ষুধার ব্যাপারে
আর আমার ক্রোধের ব্যাপারে!


এ কবিতা যেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে এক বিপ্লবী বোমা, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা মিলে যা পারেনি, কবিতার বোমায় মাহমুদ দারবিশ একাই তাই করে দেখিয়েছেন।


দিনে দিনে পৃথিবীতে সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে হিংস্রতা, অমানবিকতা, অসভ্যতা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। এ মুহূর্তে যত পারমানবিক বোমা মজুদ আছে তা পৃথিবী ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। আজকের বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় বর্তমান সভ্যতাকে পাণ্ডুর করে তুলেছে। যেন মানবতার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে আগ্রাসী হাতগুলো, কখনোবা উপনিবেশবাদ ও পুঁজিতন্ত্রের নামে, কখনো সমাজতন্ত্র, কখনো ধর্ম, কখনোবা গণতন্ত্রের নামে। এমনি প্রেক্ষাপটে কবি-সাহিত্যিকের কলম গর্জে উঠাই স্বাভাবিক এবং পাঠকের আকাঙ্খাও তাই।


তাই, বিশ্বের সমকালীন প্রেক্ষাপট প্রত্যাশা করে, সকল অসংগতি, অনিয়ম, অবিচার, অনাচার, ক্ষুধা, হিংস্রতা, আসামঞ্জ্যতা, যু্দ্ধ, অমানবিকতার বিরুদ্ধে কবিতা হোক তীব্র আঘাতের বিক্ষুব্ধ খতিয়ান। বিশ্ববিবেক জাগিয়ে তুলতে কবিতা হোক সুসংগত প্রতিবাদ এবং সমকালীন অসংগতি প্রদর্শনের স্ক্রিন।