যদি কোন শব্দসমষ্টি কোন ভাবকে বহন না করে তবে তা বাক্য বা ভাষা হয়ে ওঠে না। বাক্য বা ভাষা হবার জন্য ভাব প্রকাশ অত্যাবশ্যক। আসলে প্রচলিত সাধারণ কথা-বার্তা যে ভাবকে বহন করে তা হলো যুক্তির ভাষা। অপরদিকে কবিতা বা সঙ্গীত হলো ভাবের ভাষা।


শব্দ নিয়ে খেলা করা কবির কাজ, যেখানে ভাব ও সৌন্দর্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ, বলা যায় ভাব ও বিষয় হল কবিতার প্রাণ। কবিগুরু বলেন, “বিশ্বাস করাইয়া দেওয়া এক, আর উদ্রেক করাইয়া দেওয়া স্বতন্ত্র। বিশ্বাসের শিকড় মাথায়, আর উদ্রেকের শিকড় হৃদয়ে। এইজন্য বিশ্বাস করাইবার জন্য যে ভাষা, উদ্রেক করাইবার জন্য সে ভাষা নহে। যুক্তির ভাষা গদ্য আমাদের বিশ্বাস করায়, আর কবিতার ভাষা পদ্য আমাদের উদ্রেক করায়।”


কিছু সৌন্দর্য ও সত্য আছে যা যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, কবিতা এসকল সত্যকে প্রকাশ বা ধারণ করে। তাইতো কবিতার ভাবের ক্ষেত্রে কোন ব্যাকরণ হয়না। যেমনঃ চাঁদের আয়তন প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা, যুক্তি, মাপজোখ, ইত্যাদি দরকার হয়, কিন্তু চাঁদের সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য কবিতার প্রয়োজন হয়। অনেক না বলা কথায় অনেক কথা বলা যেন কবিতার কাজ। কবিতায় কোন যুক্তি নেই, তর্ক নেই, সৌন্দর্যের আবরণে কেবল নিজেকে প্রকাশ করে।


ভাবের ভাষার দুটি মাধ্যম - কথা ও সুর। কবিতায় কথাকে প্রাধান্য দেয়া হয়, আর সঙ্গীতে সুরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সুরের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতা থাকায় কোন কালেই ভাবের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে ভাবকে আশ্রয় করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। কারণ, কবিতা বেঁচে থাকার জন্য ভাবের চর্চা আবশ্যক। এ ভাবের চর্চা অতি সুক্ষ্ম থেকে অতি স্থুলও হতে পারে, এ ভাব অখন্ড হতে পারে আবার খন্ড খন্ডও হতে পারে। তাইতো বলতে হয় ভাব চর্চার ক্ষেত্রে কবিতার স্বাধীনতা অত্যন্ত ব্যাপক।


সুতরাং, কবিকে তার আন্দোলিত অন্তরের আবেগ-অনুভূতিকে এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে, যেন তা কল্পনা বা বাস্তবতার মিশ্রণে নির্মিত আকাশে ডানা মেলে উড়তে থাকা পাখি। সে কবিতা বাস্তবতাকে ধারণ করবে, একইসাথে কল্পনা বা অনুভবকে জীবন্ত করে তুলবে। কবিরা স্বপ্নচারী হয়েও জীবনের কথা বলবেন, যা সুন্দর তাই সত্য, তাই সৌন্দর্যের কথা বলবেন।