ধব ধবে সাদা তেজী এক ঘোড়া দুই হাঁটু মুড়ে সমুখে আমার;
বলিল সে- ‘পিঠে চেপে বসো নিয়ে যাব তোমায় বন্ধুর সব পথ
পেরিয়ে ঐ দূর পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে খেলা করে তেজহীন
রুপালী সূর্য!’ ( যে এই মাত্র ধীরলয়ে ছুটে এসে নামিয়ে দিল
পিঠে চেপে বসে থাকা রাজপুত্র সহচর তরুণ বন্ধু আমার।)
বিনীতভাবে বললাম- আমি চাপি-নি তো কখোনো তোমাদের পিঠে
তাই জানি-না কী সুখ আছে তোমাদের নরম পিঠে চেপে ছোটায়;
তার চেয়ে ঢের ভাল দুই পায়ে মাড়িয়ে যাব বন্ধুর সব পথ!
তেজী ঘোড়া ফিরে গেল বিমর্ষ বদনে অন্য সব ঘোড়াদের মাঝে।
আমি আর রাজপুত বন্ধু আমার ফিরে এলাম রাজপ্রাসাদে,
ঢের খেলাম পেটপুরে বন্ধপত্নীর নিপুন পরিবেশনায়।
তারপর আমরা তিনজন নেমে এলাম এই পৃথিবীর পথে;
বন্ধু এবং বন্ধুপত্নী দু’পাশে দু’বাহুতে জড়িয়ে চাঁদের আলোয়ে
ধীরলয়ে চলছি বিশাল বিশাল বিস্তীর্ন সবুজ প্রান্তর মাড়িয়ে!
ওদের অমিত আনন্দ উচ্ছল মুখের পানে তাকিয়ে মনেহল-
এমনি যদি অনন্তকাল ধরে চলতে পারতাম পৃথিবীর পথে,
তাহলে এ ধরায় থাকত-না কোনো জরা-ব্যাধি দুঃখ ব্যথা বেদনা
শুধু শান্তি আর শান্তি পরম শান্তি বিরাজ করত মানুষের মাঝে!


মৌন উল্লাসে উচ্ছ্বসিত প্রাণ আমার স্বপ্নময় আহা!
বন্ধুকে বলিলাম- আমরা বন্ধুর সব পথ পেরিয়ে আজ রাতে
পৌঁছে যাব পাহাড়ের চূড়ায় তেজহীন রুপালী সুর্যকে ছুঁইতে!
আমাদের উচ্ছল চেতনা কেবল ধাবিত দূর পাহাড়ের চূড়ায়!
উচ্ছল প্রাণের উতরোলে মানুষের পায়ে পায়ে চড়াই উতড়াই
পেরিয়ে আমরা দুর্গম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বেয়ে-বেয়ে উঠছি;
দেখিলাম চেয়ে- অভিমানী গোয়াড় পুরুষ এক গুহার ভিতর,
( বিরহকাতর স্ত্রী যার পড়ে আছে ডেরায়) টেনে-হেচড়ে নিয়ে গেলাম
তাকে ডেরায় এবং রমণীর কানে-কানে চুপি-চুপি বলিলাম তারে-
গাঢ় রমণীয় আদর সোহাগে জড়িয়ে রাখো-গো পুরুষ তোমার।


ফের চলেছি আমরা পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে বেয়ে মানুষের পায়ে,
হঠাৎ মুখথুবরে পড়ে গেল রাজপুত বন্ধু আমার আহা!
পরমা সুন্দরী জায়া তার বিহ্বল বিমর্ষ বদনে দাঁড়িয়ে পাশে!
নিথর শরীর তার কাঁধে বয়ে ফিরে এলাম আবার লোকালয়;
পরম যতনে নিথর দেহখানি শ্বেত শুভ্র শয্যায় শোয়ালাম!
বিবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার চুপি চুপি বলল আমায়-
‘বন্ধু তোমার দুরারোগ্য এবং নিশ্চিত পরপারের কাছাকাছি’!


তরুনী বন্ধু-পত্নীর মুখোমুখি হ’তে শুধালো বেকুল কণ্ঠে-
‘শয্যায় শায়িত বন্ধু তোমার কী হয়েছে ওর বল না আমায়’!
ঠোঁটে বিবর্ণ হাসি নিয়ে চোখে চোখ রেখে ঢের মিথ্যে তবু দৃঢ়তায়
বললাম – কিচ্ছু হয়নি ওর, শুধু দূরপাল্লার পথের ক্লান্তি;
নিবিড় গাঢ় বিশ্রামের প্রয়োজন এখন ওর পরম শান্তির জন্য!


বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ এখন আমার, প্রচণ্ড যন্ত্রণায়
বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়; গাঢ় অন্ধকারে ছুটছি শুধু ছুটছি
পেছনে ফেলে রেখে এসেছি মৃত্যুর নিকটতম অসার নিথর
দেহ এক পুরুষের আর তরুণী রমণী এক যে খানিক পরে
জীবনের সব আহলাদ আকাঙ্ক্ষা সাধ চূর্নবিচূর্ন করে
ঝেড়ে মুছে ফেলে বিধবার বেশে শাদা শাড়ীতে জড়াবে শরীর!


গাঢ় অন্ধকারে ছুটছি আমি বিহ্বল কেবল ছুটছি আমি
আর ইথারে ইথারে চিৎকারে চিৎকারে ভাসছে কেবল –
কোথায় হে! পাহাড়ের চূড়া, কোথায় আমার সেই তেজহীন
নরম রুপালী সূর্য, কোথায় জীবন, কোথায় শান্তি পরম শান্তি!!


                                                  
                                                          
জীবনমুখী কবিতা আবৃত্তির জন্য