তার লেখা কবিতাটি এইরূপঃ


অর্থ-বিত্তের জোয়ারে যে ভাসে তার হতে পারে এমনও সখ-
কিছু অর্থবিত্ত বিলোয় যদি মিটবে তাতে নিঃস্ব-দরিদ্রের হক!
বাতাসের মতই আসে যখন ভেসে অর্থ বিত্ত পাহাড় সমান  
সঞ্চিত অর্থে কী আর ঘাটতি পড়ে যাবে যদি করে সে দান?
অন্তর কভু দেয় না তো সায়, লোকচক্ষু যে চেয়ে চেয়ে রবে;
সমাজে নিজের সম্মান বাঁচাতে দান-খয়রাত যে করতে হবে।
দিনের বেলায় ঝলমলে যে আলোয় সারি সারি লোক রেখে  
সে আলোই তাকে 'দানবীর' সাজায়, লোকেরা সেটাই দেখে।
দানের থালায় সপে দেয় আরো তাঁর জমানো ঘৃণা, উপহাস;
নির্ধন দরিদ্রকে দান করে দু'হাতে, অন্তরে করে শুধু পরিহাস।
এ কেমন দান করছো হে মানুষ যে দানে নেই অন্তরের সায়?
ছলনাময় সে বিশাল দানে কি পরম দয়ালুর মন পাওয়া যায়?
দান যদি কভু করতেই হবে তবে সে দানে জেনো হৃদয় রয়,
যে দানে নেই প্রেম ও শ্রদ্ধা তা কী করে সুন্দর ও সমগ্র হয়?


জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত কবিতাটি। দান সম্বন্ধিত আলোচনা করা কবিতাটিতে সামাজিক বৈষম্য ধনী গরীব তথাকথিত ক্রোরপতি আরবপতি মানবজনের কিছু বিকৃত রুচি তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত সুনিপুণতার সহিত। খুবই সহজ সরলভাবে কবিতাটি লেখা। একবর্ণ কথাও বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নহে। সংক্ষিপ্তভাবে লেখাটির মূল বক্তব্য তুলে ধরলাম।


"সে ধনী জনেরা সামাজিক কৌলিন্য অর্জন করবার নিমিত্তে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে কিছু দান ক্ষয়রতি করে থাকেন। যে দানে দম্ভ অহঙ্কার আর স্বার্থ মিশে থাকে সে দান দান নহে, সে দানে পুণ্য অর্জিত হতে পারেনা।" একশো ভাগ খাঁটি কথা। কথায় আছে,"নেকি কর দরিয়া মে ডাল"। ঢাক ঢোল পিটিয়ে দান করে সুদে আসলে তার লাভ তুলে নেওয়া।  অসাধারণ কাব্যিক প্রকাশ।


তবে কবিতার প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসা ধনী ও গরীব বর্গের এই বৈষম্য, কেন কিভাবে তা আমার অভিজ্ঞতার নিরিখে পর্যালোচনা করবার প্রচেষ্টা করলাম।  চলুন  ফিরে দেখা যাক সমাজকে। মানব সমাজ কয়েকটি শ্রেনীতে বিভক্ত। প্রধানত দুই ভাগঃ উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয়। এই নিম্নবর্গীয় শ্রেনী আবার কয়েকটি উপশ্রেনীতে বিভক্ত, যেমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও তারও নীচে গরীবেরও নীচে মানে যাদের খাবারও জোটে না সপ্তাহে প্রত্যেক দিন বা বেলা।


এবার আমরা চিন্তা করি উচ্চবর্গীয় শ্রেনীদের নিয়ে। তাদের প্রচুর ধন সম্পত্তি, দেদার রোজগার, আয়েস তাহাদের ভূষণ কৌলিন্যে মেতে থাকা তাদের স্বভাব। এই প্রতিটি ব্যাপারই ধন সম্বন্ধিত। কোনও গরীব লোকও যদি হটাৎ ধনী হয়ে ওঠে তবে তার মধ্যেও এ গুণগুলি হটাৎই জাগ্রত হয়। স্বাভাবিক মানবিক মতি গতি।


এখন প্রশ্ন হলো কেন এই শ্রেনীবিভাগ, কেন ধনী আর গরীব। যিনি ধনী তার তো একদিনে এত বিত্ত এত প্রভাব প্রতিপত্তি বিষয় আসয় সম্পত্তি গড়ে ওঠেনি। এটাও মনে রাখতে হবে "রোম ইজ নট বিল্ট ইন এ ডে"। আজকালকার দিনে অর্থ উপার্জন খুব একটা সহজ নয়। অনেক ধৈর্য, বুদ্ধি বিবেক, শ্রম প্রচেষ্টা না থাকলে অর্থ উপার্যন সম্ভব নয়। এখানে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, "যারা অবৈধ অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্যন করে", তাদের নিয়ে এ আলোচনা নয়। তারা তো সামাজিক ব্যাধি। তারা দুর্নীতিপরায়ণ ও সামাজিক অবক্ষয়ে্র গোড়ামূল, তাদের ধ্বংস করতে না পারলে সমাজ সংস্কার কখনই সম্ভব নহে।"


আমি আলোচনা করতে চাই সে সকল লোকেদের নিয়ে যারা সৎ উপায়ে উপার্জন করে আজ কোটিপতি আরবপতি। তাদেরকে আমরা দোষ দেব কিভাবে! আপনি লিটল মাস্টার শচীন তেন্ডুরকর বা হাজার আরো ক্রিকেটার, সিনেমা আর্টিষ্ট , বড়ো ব্যাবসায়িক প্রতিষ্টান , প্রফেশনাল যেমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, সৎ সরকারী আমলা-কেন দোষ দেব তাদের। ধনী হওয়া দোষের কী? ধনী কে না হতে চায়! জীবনটাকে উপভোগ কে না করতে চায়!


আর একটু ভেতরে গেলে আমরা ভাবতে পারি-ধনী কেন ধনী আর গরীব কেন গরীব। ঈশ্বর তো সবাইকেই সমান ভাবে তৈরী করেছেন। বুদ্ধি বিবেক হৃদয় কার বা কম দিয়েছেন। তবে এটা হয়, "অনেকে সোনার চাঁমচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে আর তার পরিনাম অনেক ক্ষেত্রেই বিভৎস হয়ে থাকে। মাদক নেশা নারী ইত্যাদিতে মসগুল তারা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে", আমার এ আলোচনা তাদের নিয়েও নয়। ভগবান অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও সত্যই কবি বানিয়ে দিয়েছে আমাকে। তাই মাঝে মধ্যে ভাবতে বাধ্য হই পরমপ্রিয় ভগবানের দানে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিছু লোক কিভাবে ধনী হয়ে ওঠে আর কিছু লোক গবীব তো গরীবই থেকে যায় জীবনভর।


কারণ অনুসন্ধানে যা পেয়েছি সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। শ্রম নিষ্ঠা একাগ্রতা মহানতা পেশার প্রতি একনিষ্টতা এই গুণগুলি নিজেকেই অর্জন করতে লাগে। এ দান ভগবানের নয়। নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং সেই দিশায় নিজেকে তৈরি করা তা একান্ত নিজের ব্যাপার। একটা কথা আছে, "ভগবান তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজে নিজেকে সাহায্য করে।" আজকের দিনে লক্ষ্য করি প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণের পর নিয়মিত সরকারী চাকরির পরীক্ষা দেওয়া আর ফেউ ফেউ করে বছরের পর বছর অতিক্রম করা। সাথে আছে নিয়তিকে দোষারোপ করবার পালা-"কেন সে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে আমার কেন হলো না"। হাসি পায়। এরা যেন সরকারী চাকরী পাবার নিমিত্তেই শিক্ষাগ্রহণ করেছে-মানুষ হতে নয়। ব্যতিক্রম হাজার হাজার রয়েছে যারা কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ঝাপিয়ে পরে তা অর্জন করতে। হাজার রকম বৃত্তিমূলক শিক্ষা রয়েছে যা একনিষ্ট ভাবে সম্পন্ন করতে পারলে সে লাইনেই জীবনকে গড়ে নেওয়া যায়। ছোট থেকে বড় হতে হতে একসময় ধনী হয়ে ওঠা যায়। আমি নিজেই সে ব্যতিক্রমী একজন। গ্রাজুয়েশান এর পর বাবা যিনি গ্রেফ এর জুনিয়ার কমিশন্ড অফিসার ছিলেন আমায় ১৯৯০ সালে পূনা হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যান এবং জানিনা কি ভাবে কি উপায়ে আমার চাকরির ব্যাবস্থা করেন। সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের চাকরি। পোস্টিং হয় বাবারই কর্মক্ষেত্রে "বার্মা বর্ডার জিরো পয়েন্ট লুংতলাই", ছয় মাস চাকরি করে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। বাবাকে একথাই শুধু বলে এসেছিলাম "জীবনে কিছু করতে হলে আমি শিলিগুড়ি থেকেই করব আর তা করবো ব্যাবসা করে", জীবনে সরকারী চাকরির পরীক্ষা দেই নাই। যাই হোক জীবন তো প্রায় পার করে দিলাম। বাড়ি গাড়ি ব্যাবসা সবই রইছে। ভাবলে অবাক হবেন এই বয়সে আমি ডি এম বি এস এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আর এম পি তো আগেই করে নিয়েছি। উদ্যম থাকলে কি না হয়। হ্যা, এটা ঠিক পরিবেশ কিছুটা দায়ী মানসিকতা তৈরি করবার জন্য।


আমার এত কথা বলবার একটাই উদ্দেশ্য "চেষ্টা লগন হিম্মত শ্রম ইচ্ছাশক্তি আর বড় হবার নেশা থাকলে কেন গরীব গরীব থাকবে। আমি অনেক গরীব লোককেই সমাজে উঠে আসতে দেখেছি। সবাই কম বেশী দেখে থাকবেন।


আমার উদ্দেশ্য গরীবকে অপমান করবার নয়। উজ্জিবিত করবার প্রচেষ্টা মাত্র। আর যারা হত দরিদ্র তাদের জন্য তথাকথিত ধনী সম্প্রদায় কৌলিন্য দেখাবার অভিপ্রায়েই মিডিয়া ডেকে এনে দান ধ্যান করে, করুক না। এতে তাদের পুণ্য অর্জিত না হলেও সে সকল হত দরিদ্র মানুষ গুলির তো উপকার হবে। তাই তো আমি কবিতায় ব্যক্ত করেছি এমন দানের প্রতিযোগিতায় নামুক না তারা। প্রতিটি ধনী মানুষের মধ্যে এমন কৌলিন্য অর্জনের ক্ষুদা জেগে উঠুক । প্রতিযোগিতায় নামুক একে অপরের সাথে। বিন্দু বিন্দু সে দানে সিন্ধু তৈরি হতেই পারে।


কবিতাটি এখানে দিলাম।


বন্যা


হোক সে মেকি তাও সমাদর নাই গ্রহনে কৃপণতার দাস,
লোভ লালসায় তাও যদি বা
খুলতে হৃদয় ফাঁস।
মহানতার ছোঁয়াচ যদি নাই বা রচে প্রাণ,
চায় যদি বা আলোক স্রোতের
বন্যা অবিরাম।
নাই বা রয় হৃদয় তাহে নাই বা রহে সুর,
ক্ষণিক দানে মানবতায়
দানব সুরাসুর।
যতন ধরি মুক্তামালা দু'কর করি জোড়,
দাওনা প্রভু দানব সবে
এমন বরাত জোর।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান সবে তার হিল্লোলে সাগর,
ঘুচতে তুষার গহীন তমা,
আঁধার ঘনঘোর।


অসাধারণ একটি কবিতা উপহার দেবার জন্য প্রিয় কবিকে জানাই হার্দিক অভিনন্দন। অনেক অনেক শুভকামনা সহ আপনাদের প্রিয় সঞ্জয় কর্মকার।