"পথশিশু"
কবি : মোঃ রাসেল আহমেদ খান


আমি জীব খোদার সৃষ্টি মানুষ;
তবে ওরা কি মানুষ নহে!
আমার জীবন, জীবন্ত আমি-
তবে ওরা কি জীবন্ত নহে!
তবে কেন এত অমিল? কেন এত অসাধারণ দূরত্ব?
প্রশ্ন জাগে মনে।
যখন হিম কূহেলি ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে আর শন শনে বায়ু কন কনে শীত বিলায়-
ওই রজনীতে।
তখন নিজেকে লুকিয়ে রাখি চার দেয়ালের ঘরে
উর্ম চাদরে কোমল বিছানায় জড়িয়ে রাখি নিজেকে,
ভাবি আনন্দ বিলাসের যতসব রঙ্গ ভঙ্গ ভাবনা।
একবার ও ভাবিনা খোলা আকাশের নিচে পথের ধারে উলঙ্গ গায়ে পরে থাকা-
পথ শিশুটির কথা।
তবে কি সেই উর্ম, উষ্ণতা, রঙ্গিন ভাবনা আমার
সত্য কারের সুখ দিতে পারে?
প্রশ্ন জাগে মনে।
যখন কোন খানে দুহাত পেতে চেয়ে থাকে আমার পানে কোন এক "পথশিশু"
এক মুঠ অন্নের লাগি
দেখে মনে হয় কতদিন সে খায়নি চোখ দু'খানা শুকিয়ে গেছে
হয়ত জলও নেই তাতে তাই সে কাঁদতে পারছেনা।
কন্ঠটা বন্ধ হওয়ার পথে প্রায়-
তাই সে চিৎকার করে বলতে পারছেনা আমি খাব!
আমায় খেতে দাও! আমায় খেতে দাও!
জোটেনি তার অন্ন কপালে!
তাড়িয়ে দিলাম তাকে!
তাকে ওকে ওদেরকে অনাহারে রেখে
খেয়ে নিলাম, খেয়ে নিচ্ছি সবটুকু সব খানি!
তবে কি সে অন্ন সত্যকারের ক্ষুদা মিটাতে পারে?
এত এত প্রশ্ন, এত ভাবনার ব্যাথা আমি যে আর সইতে পারিনা।
আমি রইতে পারি না এই প্রাসাদ,
আমায় যেতে দাও! আমায় যেতে দাও!
ডেকোনা আমার পিছু!
আমিও হব ওদের মত; হব পথশিশু।


মানুষের জন্যে পৃথিবী। এই ধরাতলে সব জীবকূলেরই জীবন ধারণের সমান অধিকার। বন্যেরা থাকে বনে আর সুসভ্য প্রজাতির মানবকূল গ্রাম শহর নগর তৈরি করে বসবাস করে। মানুষ ব্যতীত অন্য সব জীবকূলের একে অপরের সাথে খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক। খাদ্য শৃ্ঙ্খলে আবধ্য তারা জীবন ধারন করে। কিন্তু সুসভ্য মানব কূল সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকবার অভিপ্রায়ে সৃজন করেছে সমাজ এবং সামাজিক কিছু নিয়ম কানুন। খাদ্য খাবারের জন্য কৃষি ভূমি সৃষ্টি আর কৃষিকাজ করে খাদ্য পণ্য উৎপাদন। সভ্য মানব কূলে প্রথম প্রথম চলত বিনিময় প্রথা। ধীরে ধীরে বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে প্রচলিত হয় টাকা পয়সার। টাকার বিনিময়ে মেলে খাদ্য খাবার থেকে জাগতিক সুখের সমস্ত উপকরণ। আর এ করনেই এ সমাজে তৈরি হয় বিভেদ। একশ্রেণীর মানব কূলে সৃষ্টি হয় ধনের পাহাড়। তারা পরিচিত হয় উচ্চবিত্ত নামে। মধ্যম আয়ের মানুষেরা হলো মধ্যবিত্ত আর নিম্ন আয়ের ব্যক্তিরা হলো নিম্নবিত্ত যাদের আমরা গরীব বলেই চিহ্নিত করে থাকি। তারও নিম্ন আয়ের  লোকেরা হলো হত দরিদ্র বা বি পি এল অর্থাৎ বিলো প্রোভার্টি লাইন মানে গরীবেরও নিচে। পথে ঘাটে এদের স্থান। ফুটপাত হলো এদের জগৎ । ভাগাড়ে আস্তাকুড়ের বাসি পচা ফেলে দেওয়া খাবার এদের খাদ্য। এদের শিশুরা পথে ঘাটে মানুষ হয়। ভাগাড়ে খুজতে থাকে খাবার। কাঁধে বস্তা নিয়ে ডাস্টবিনে এইসব শিশুরা খুজতে থাকে প্লাস্টিকের টুকরো আর ফেলে দেওয়া এটা সেটা দ্রব্য। সারাদিন সংগ্রহ করে তা কিলো দড়ে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে যা পাওয়া গেল দুমুঠো খাবার জন্যে। এরা পথশিশু নামেই পরিচিত হয়। এদের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কোন দিন এদের খাবার জোটে আবার কখনো বা দিনের পর দিন অর্ধাহার অনাহারে দিন কেঁটে যায়। বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া এদের সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা থাকে না। করুণ চোখে হাত পাতে বাবু সাহেব দের কাছে সামান্য কিছু ভিক্ষা পাবার আশায়। চরম অবহেলায় বাবু সাহেবেরা এদের হটিয়ে দেয়। চরম ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই তারা দিতে চায় না তাদের। এই কি সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা। এই জন্যই কি সভ্যতা আর সমাজ সৃজন। এই কি জীবশ্রেষ্ট মানব কূল তার আচার বিচার ব্যবহার।


কবি তার কবিতার শুরুতেই এক প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছেন। মহান খোদা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এক ধরা দিয়েছেন তাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকবার জন্যে। তবে কেন এত বিভেদ? প্রশ্ন তুলেছেন তবে কি ওরা মানুষ নয়। খাদ্য বস্ত্র সুরক্ষার অধিকার কি ওদের নেই। দারুন সুন্দর মানবিক প্রশ্নে কবিতার শুরু।


শীতকাল এলে সৌখিন ঘরের চার দেওলের মধ্য কোমল গদির বিছানায় গরম লেপের তলে শুয়ে তিনি পরম সুখে দিন কাঁটান আর শীতকালীন বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের কথা ভাবতে থাকেন। কই তখন তো তার একবারও মনে পরে না রাস্তার সেই সব পথ শিশুগুলির কথা। মনে পরে না বলতে সমাজের আর সমস্ত আয়েসপ্রেমী মানুষ জনের কথাই বলতে চেয়েছেন। তারা কি কখনো ভাবেন ভীষণ শীতে কি করুণ পরিস্থিতির মধ্যেই না সে সব পথশিশুরা প্রবল শৈত্য প্রবাহে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কি নিদারুন কষ্টেই না দিন অতিবাহিত করে। তারা তো গায়ে গরম কাপড় টুকুও পায় না। ভয়ঙ্কর শৈত্যপ্রবাহ সহ্য করতে রাস্তার ধারে খড় কূটো জ্বালিয়ে গা গরম রাখবার নিদারুন প্রয়াসে ব্যস্ত থাকে। অসুস্থ হয়ে পরে তারা। ঔষধ পত্রের অভাবে কেউ কেউ মারাও যায়। এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে কবির মনে প্রশ্ন জাগে ঘরের কোমল বিছানা গরম চাদর শীতকালীন বিভিন্ন আনন্দ উৎসব সত্যই কি এনে দিতে পারে সুখের ছোঁয়াচ?বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় কবির হৃদয়। প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন কবি সমাজের তথাকথিত ধনী আর আয়েস প্রেমী মানব ইতিহাসে। সত্যই কি আমরা সভ্য জাতি আর জীবশ্রেষ্ট মানব কূল?


ক্ষুদার্থ এই সব পথ শিশু ক্ষুদার তারনায় সামান্য কিছু ভিক্ষার আশায় যখন হাত পাতে তথাকথিত সাহেব বিবিদের সন্মুখে তীব্র বিতৃষ্ণা আর চরম ঘৃণায় তারা হাটিয়ে দেন তাদের। ভিক্ষাদান তো দূরের কথা। না খেয়ে খেয়ে হয়তো তাদের চোখের জলটুকুও শুখিয়ে গেছে। কন্ঠ রুদ্ধপ্রায়। তাই তো তারা কাঁদতেও পারে না মুখ ফুটে চিৎকার করে খাদ্যের দাবি জানাতে ভয় পায়। বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে পারে না এ পৃথিবীতে আমাদেরও সুস্থ ভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার অধিকার আছে। এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তাই কবির কোমল মনে প্রশ্ন জাগে বিভিন্ন পন্থায় বৈধ অবৈধ ভাবে অর্জিত অর্থে চব্য চোস্য লেঝ্য পেয় খেয়ে সত্যই কি আমাদের ক্ষুদা মিটতে পারে?হাজার হাজার পথশিশুকে বঞ্চিত করে যে খাবার গ্রহনে উদর তৃপ্তি তা কি সত্যই ক্ষুদা নিবারণ করতে পারে। না না না। তা কখনই হতে পারে না। এক আকাশ তরিৎ বাণ কবি আছড়ে ছুড়ে মেরেছেন তথাকথিত ধনী এবং কপট সমাজের বুকে। সত্যই কি আমরা সুসভ্য জাতি শ্রষ্ট মানব কূল?


কোমল কবিমনে এসব যাবত প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অবিরত। এত সব প্রশ্নের মাঝে কবির কবিমন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দারুন ব্যথায় কোমল হৃদয় ছারখার হতে চায়। তাই তো কবি পথশিশু হতে চান। প্রাসাদ ছেড়ে তাদের সাথে থেকে চিৎকার করে মানব সভ্যতাকে বলতে চান। আমরা পথশিশু। আমাদেরও এক পৃথিবীতে সমান ভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার অধিকার আছে। ছিনিয়ে নিয়ে সে অধিকার তাদের সাথে থেকে তাদের উত্তরণ করতে চান।


অসাধারন মানবিক লেখা উপহার দেবার জন্যে প্রিয় কবি মহোদয় কে জানাই আমার হৃদয়ের উষ্ণ অভিনন্দন।