কবিতা বলতেই সাধারণের মাথায় আসে “আজি এ প্রভাতে রবির কর”, “দুর্গম গিরি কান্তার মরু” কিম্বা “আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো” ইত্যাদি বিখ্যাত লাইনগুলি। এর আগেও ছিল, যেমন “আশার ছলনে ছলি কী ফল লভিনু হায়”, “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি” ইত্যাদি।
বিবর্তনের পথ ধ’রে ক্রমে এলো “চুল তার কবেকার আন্ধকার বিদিশার নিশা” থেকে শুরু ক'রে “আমি যখন ছোট ছিলাম খেলতে যেতেম মেঘের দলে,/একদিন এক মেঘবালিকা,  প্রশ্ন করলো কৌতুহলে”
    যাই হোক উপরের সব লাইনগুলিই সুন্দর এবং নিখুঁত ছন্দে লেখা। কিন্তু লেখায় বৈচিত্র আনতে রবি ঠাকুরই লিখে ছিলেন- 'আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,/চিনবে না আমাকে,/তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,/বাসি ফুলের মালা।' কেউ বলে এটা আধুনিক কবিতা, কেউ বলবে গদ্য কবিতা। এবার হালের একটা উদাহরণ- 'আমিই সেই মেয়ে।/বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন/যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি/আপনি রোজ দেখেন।'
     উপরের সব কবিতাগুলিই বিখ্যাত এবং সকলের ভালো লাগে। হয়তো কারুর এটা বেশি তো কারুর ওটা বেশি। কিন্তু কেন ভালো লাগে? সঠিক উত্তর দেওয়া বেশ মুশকিল। তবে একটা জিনিস কিন্তু বলা যায়। সব লাইনেই ছন্দের মুন্সিয়ানা আছে। কেউ যদি শেষ উদাহরণ দুটিকে গদ্য কবিতা বলে, বলতে পারে। কিন্তু আদতে ওগুলি একেবারেই গদ্যের মতো নয়। ওরকম ভালো লাগা লাইন লিখতে গেলে আগে ছন্দে পারদর্শী হওয়া একান্তই প্রয়োজন। তার উপরে artistic কাব্যিক expression তো আছেই। কলম ধরলেই যদি সবাই কবি হয়ে যেত তবে জীবনানন্দকে বলতে হত না “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” আমি কাউকে নিরুৎসাহ করতে চাইছি না, শুধু ভাবতে বলছি কীভাবে নিজের কবিতাকে আরো সুন্দর করা যায়। কবিতায় মিল দিতেই হবে তেমন বাধ্যবাধকতা এখন হয়তো নেই, কিন্তু ছন্দ বাদ দিয়ে কিছু গদ্যের মতো লাইনকে ছোট বড় ক’রে লিখে দিলেই কি তা কবিতা হয়? সুন্দর কবিতার প্রতি প্রেম যে সব কবির আছে তাদের ভাবতেই হবে, বর্তমান আধুনিক কবিতা থেকে সাধারণ পাঠকক পাঠিকারা মুখ ঘুরিয়ে আছে কেন? মন ভোলানো কবিতা লিখতে গেলে নিষ্ঠা চাই সাধনা চাই এবং অবশ্যই ছন্দ বোধ এবং ছন্দের প্রতি মমত্ব বোধ চাই। তা না হলে তো কবিতা না লিখে পুরো গদ্যতেই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে দেওয়া যায়। কবিতাকে ভালোবাসি ব’লেই বড় কষ্টের সাথে বলছি আসরের অনেক কবিতাতেই না মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে কাব্যকে না গদ্যকে।
     সব শেষে রবি ঠাকুরের সেই সতর্ক বাণী আবার শুনিয়ে দিই-
   “সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি
    ভালো নয়, ভালো নয় সে শৌখিন মজদুরি”