আমার একটি পুরনো কবিতায় কিছু মন্তব্য ও প্রতিমন্তব্য নতুন ক'রে আর একবার পড়তে হয়তো পাঠক বন্ধুদের মন্দ লাগবে না।


হাসান ইমতির মন্তব্য - ছন্দের হাত ধরেই একসময় কবিতার জন্ম হয়েছিল এটি যেমন সত্যি তেমনি কবিতার এই বিবর্তনও মিথ্যে নয়, তবে ছন্দ ভাঙা ও ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞানের ভেতর আমি কোন বিরোধ দেখি না, পরিণত আধুনিক কবিতা লিখতে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ে সহজ সরল ছন্দের পাঠ থাকা মন্দ নয়, আমি এই আলাপকে কবিতার বিবর্তনের সুত্র ধরে একটু পেছনে নিয়ে যাব ।


আশি, নব্বই এবং বিংশশতকে বাংলা কবিতায় ক্রমাগত হারে নিরীক্ষা করেছেন এবং এখনো নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন কবিরা। কবিতার আঙ্গিক নিয়ে, শব্দের ব্যবহার নিয়ে, উপমার নতুনত্ব নিয়ে, ছন্দের কারুকাজ নিয়ে, পূর্বসূরিদের প্রভাব বলয় থেকে বের করে কবিতাকে নতুন পথে নিয়ে আসার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। আশির দশক কবিতার আরেক বাঁক বদলের ইতিহাস। এসময়ে কবিতায় অপ্রত্যাশিত ভাবে ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার চর্চা যার অন্যতম প্রধান কারণ এই সময়ে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবত ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষের পথে হেঁটেছে। কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়ে যায়। তারপরও আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছে আলোড়িত করার মত অসংখ্য সত্যিকার অর্থেই সুন্দর আর নান্দনিক পঙক্তিমালা। সময়ের প্রয়োজনেই আশির দশকের এ কবিতাগুলো চির সুন্দর দ্যোতনায় দ্যূতিময়। এ প্রসঙ্গে কবি ফরিদ কবিরের এই কবিতাটা আনার লোভ সামলানো গেল না।


আমি কোনো মৃত্যু, কোনো জীবন বুঝি না। উৎসবের
পূর্বে এই করতলে কেঁপে ওঠে চিতার আগুন
হাতের চামড়া আর রোমকূপ পুড়ে পুড়ে তৈরি
হয় রণাঙ্গন, আমি অজস্র অশোক পুষ্প ছুড়ে
দিতে থাকি বিপক্ষের কংক্রিট তোরণে, তারপর
কী রকমভাবে যেন পড়ে থাকি নিহত মানুষ
(আত্মযুদ্ধ/ফরিদ কবির)


এসময়ে ব্যাপক লিটল ম্যাগ চর্চার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক কবিতা চর্চার বিকেন্দ্রীকরণ হয় ব্যাপক ভাবে। জাতীয় পর্যায় থেকে কবিদের এই বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকার ভাল এবং খারাপ দিক দুটোই ছিল। প্রথমত কবিতা কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য কবিদের নামের তালিকা করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য এর পেছনে উত্তরাধুনিক কাব্যচর্চার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কবিতা সাধারণের বোধগম্যতার নাগাল ছেড়ে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। তাই এই সময়ে ব্যাপক কাব্যচর্চা হলেও সাধারণ পাঠকের কবিতা পাঠের হার আশংকাজনকহারে হ্রাস পেতে থাকে। এবং সত্যি বলতে কি এই আকাল নব্বই দশককে প্রবলভাবে স্পর্শ করে ।


নব্বই দশকেও এমন বিকেন্দ্রীকরণ এবং চর্চার স্বাধীনতা চলতে থাকার কারণে কবিতা হয়ে উঠতে থাকে উচ্চমার্গের বিমূর্ত শিল্প। তবু এর মধ্যে কিছু কবি লিরিক্যাল কবিতার নতুন এবং নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেন। দুর্বোধ্যতার তোরণ ছুঁয়ে গেলেও কবিতা মোহময় হয়ে ওঠে। একটি উদাহরন দেই


তবু এই বিন্দু বিন্দু ঘাসের শিশিরে
চুরি যাওয়া পুকুরটা পাওয়া যায় ফিরে
এইসব দেখি আর না দেখি অধিক
অন্তরনগর ট্রেন, চলে ঝিকঝিক
...............অন্তরনগর ট্রেন


কবিতার আঙ্গিকে নানান নিরীক্ষা চলতে থাকে। অণুগল্প আকারের গদ্য আঙ্গিকের কবিতা চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। গদ্য রচনায়ও কবিতার প্রভাব দেখা যেতে থাকে। শূন্য দশকে এ দুইয়ের সমন্বয়ে মুক্তগদ্য নামে একটু নতুন ধারার সূচনা হয়। মোট কথা কবিতা নিয়ে যত রকম নিরীক্ষা করা যেতে পারে তার সবই এ তিন দশকে ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। একদিকে কবিতাকে উল্টে পাল্টে দেখার এবং নতুন মোহনায় পৌঁছে দেবার সব রকম আয়োজন চলতে থাকে।


পরবর্তী দশকের মাঝামাঝি এসে অন্তর্জালে সাহিত্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশ্ব সাহিত্যের সংগে পরিচিতি হয়ে ওঠে যে কোন সময়ের চাইতে সহজ। এ ছাড়াও দুই বাংলার কবিতা এক ছেদবিন্দুতে দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে অন্য যে বিষয়টা এসেছে সেটা হল কোন গ্রন্থ প্রকাশ না হওয়ায় বা প্রকাশ হলেও প্রচারে এগোতে না পারায় যে দুই বাংলার যে কাব্য প্রতিভাগুলো আড়ালে থেকে যেত সে প্রতিভাগুলোও আমাদের সামনে এসেছে। বাংলা কবিতা বরাবরই পাশাপাশি প্রবহমান দুটো ধারায় চলছিল। একটি পূর্ববঙ্গ অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যতটা পরিচিত অন্যরা ততটা নয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামীদের মত কবিরা বরাবর আমাদের আওতার বাইরে ছিলেন তাদের চমকপ্রদ সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে। অন্যদের কথা তো বলার সুযোগই নেই। এমনকি এই শেষ তিন দশকে যে কবি সাধারণ পাঠকের সবচেয়ে কাছাকাছি চলে আসতে পেরেছেন সেই শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত আমাদের কাছে এতদিন অপরিচিতই ছিলেন। অন্তর্জাল শ্রীজাতর সৃষ্টিসম্ভারের কিছু অংশ অন্তত আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে। মোট কথা শূন্য দশকের শেষাংশে একবিংশ শতকের প্রথম দশকে এসে আমরা দুই বাংলার কবিদের এক প্লাটফর্মে পাবার সুযোগ যতটা পেয়েছি ততটা এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। দুই বাংলায় কবিতার বিকাশ এক সমান্তরালে হয়নি। আশির দশক থেকে আমাদের দেশে ছন্দ অন্ত্যমিলের চর্চা বেশীরভাগই পূর্বতন কবিদের হাতে হয়েছে। নতুন সময়ের কবিরা ছন্দ অন্ত্যমিলচর্চাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বর্জনই করেননি অনেক ক্ষেত্রে তারা সরাসরি বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং সেটা মোটামুটি শক্তভাবে। কিন্তু একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ছন্দ অন্ত্যমিলের চর্চা ছিল উল্লেখযোগ্য হারে বেশী।
কবিতার প্রথমযুগে যেমন ছন্দ অন্ত্যমিলের পক্ষে কিছু গোঁড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই প্রজন্মে এসেও একদল গোঁড়া কবিদের আবির্ভাব ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থান এই দুই মতবাদের মাঝামাঝি। যে যুক্তিতে অন্ত্যমিলকে বর্জন করতে চান এখনকার কবিরা সে যুক্তিতে অন্ত্যমিলকে ধরে রেখেই নতুন ধারার অন্ত্যমিল চর্চার পক্ষে আমার দৃঢ় অবস্থান। এবং এ প্রসঙ্গে শুদ্ধ ছন্দের ও অন্ত্যমিলের চর্চাকেও আমার কাছে খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় না। মূলত শুদ্ধ ছন্দের চর্চা থেকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছন্দ চর্চাকারী কবিরা অনেক আগে থেকেই ফিরে এসেছেন। অন্ত্যমিলের বৈচিত্র্যও আমাদেরকে শিখতে হবে আর তা শিখতে হবে অন্ত্যমিলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই। যে কোন সৃজনশীল চর্চা বৈচিত্র্য ছাড়া টিকিয়ে রাখা মুশকিল।


আমার প্রতিমন্তব্য - হাসান, তোমার দীর্ঘ লেখা প'ড়ে আমার জ্ঞানের পরিধি অনেকটাই বিস্তৃত হল। সত্যি কথা বলতে কি, এত গভীর ভাবে ভাবিও না কখনো। স্বভাব বসে এবং ঝোঁকের বশে লিখে যাই। কবিতা নিয়ে experimentএর কথা ভাবনাতেই আসে না। আসলে আমি কবিতা প্রেমিক, তুমি কবিতা সাধক। যাই হোক তোমার এত কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি কী যে বলি। স্বাভাব বসে না হয় দুকলি লিখেই দিই সেই ছন্দে।


থাকলেই সুন্দর তাল মিল ছন্দ
কেউ ভাবে কবিতায় প্রকৃত আনন্দ।
কারো মতে সুলিখিত কবিতার সর্ত-
থাকা চাই সে লেখাতে গূঢ় কোনো অর্থ।
কেউ বলে কবিতার ভাষা হোক গদ্য,
পড়তেও যেন বেশ লাগে দুর্বোধ্য।
কবিতার ধারা নিয়ে দিতে গিয়ে শিক্ষা
আধুনিক কবিদের কত কী পরীক্ষা।
আমি বলি এই নিয়ে মিছে করা যুক্তি,
হৃদয়ের রস-বোধে কবিতার মুক্তি।
ভেবে ভেবে বুড়ো যারা, ভাবে তারা ভাববে,
মনে দোলা লাগাটাই শেষ কথা কাব্যে।


বোদরুল আলমএর মন্তব্য - সুললিত ছন্দের সাথে আপনার নিবিড় যোগ এমনই যে, আপনি তাকে ছুটি দিতে চাইলেও নাছোড়বান্দার মত সে আপনাকে ছাড়বেনা। আপনার হাঁচিতে কাশিতেও মনে হয় যেন ছন্দের শ্রুতিমধুরতা। উপভোগ্য ও সহজ ছন্দের হাত ধ'রে মনের কথাটি যেভাবে ফুটিয়ে তোলেন, তা' অনেক ছন্দ-সাধকের কাছে শিক্ষণীয় যেমন, কখনো সখনো মনে হয় ঈর্ষণীয়ও হয়ে উঠতে পারে। আসরের ছন্দ-ঋষিকে আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।


আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে 'কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি'-গোছের সরল ছন্দের তালে নাচতে ভালোবাসি। এমনকি আমার অবচেতন মনের গভীরে (হয়ত তা কিছুটা হ'লেও সংকীর্ণ, সেদিক দিয়ে) আজও কবিতা বলতে ছন্দোবদ্ধ কবিতাই আদৃত হয়। যদিও সময়ের সাথে হাঁটার বাধ্যতা থেকেই আজকের আধুনিক কবিতা হিসাবে যে সব উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা হয়, তা'তেই আপাততঃ খুঁজে ফিরি কাব্যরস। অনুভব করার চেষ্টা করি কবিতার স্পন্দন। আর এই বাধ্যতাসর্বস্ব অভ্যাস থেকেই আজ তাই শুধুই কবিতার শরীরে লুকিয়ে থাকা প্রাণানুভূতি খুঁজে ক্ষান্তি দিই। কবিতার কাঠামো আজ তাই আমার কাছে শুধুই গুরুত্বহীন এক উপেক্ষণীয় সজ্জা মাত্র।


আমার অবচেতন মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই বিশ্বাসের টানেই তাই আসরে এলেই, আপনার কবিতা নিঃশব্দে পড়ে নিই। সুখকর ছন্দের ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেওয়া বার্তাটুকু নিয়ে নিই। বিমুগ্ধ হই। বিমোহিত হই। নীরব মন্তব্য ফেলে রেখে পরিতৃপ্তির আবেশটুকু নিয়ে নাচতে নাচতেই তারপর ফিরে যাই আপনার পাতা থেকে। কবিকে আরো একবার জানাই আমার বিনম্রচিত্ত কুর্নিশ। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে। ভালো থাকবেন।
উত্তর দিন


আমার প্রতিমন্তব্য - খুব আপ্লুত হলাম ভাই তোমার মন্ত্যব্যে। "কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি" তো one ideal example of great poems. একটি নিপুণ নিটোল ছবি যেন। আগে যার ছন্দ বোধ দুর্বল সে নিজেকে কবি ভাবার কল্পনাই করত না। কবিতা ও ছন্দ প্রায় সমার্থক ছিল। ছন্দ কবির অন্তরায় ছিল না, ছিল উত্তরণের পথ। কিন্তু কবিতার দুর্ভাগ্য, আমাদের দুর্ভাগ্য, ছন্দ, মিল যেন কবিতা সৃষ্টির বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে সস্তায় বাজি মাৎ করতে চাওয়া কবির দল এখন বেনোজলের মতো ঢুকে পড়েছে কবিতার বাজারে। ছকে বাঁধা ছন্দেই যার হাত পাকল না সে মুক্ত ছন্দে সুন্দর কাব্য(বা গদ্য কবিতা) সৃষ্টি করবে কীভাবে! এরা বোঝেই না সত্যিকারের ভালো আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতা লেখা কতটা কঠিন। তোমার মতো কবিদের পাশে পেলে একবার চেষ্টা ক'রে দেখতে পারি, ভালো কিছু সৃষ্টি করা যায় কিনা।