(উদ্ যোগপর্ব –এর ভগবদ্ যানপর্ব্যাধ্যায়-এ আমরা কৃষ্ণ-কর্ণ-সংবাদ উল্লেখ পাই। ভগবানের সাথে মহারথির কথোপকথন সত্যই শিক্ষণীয়। তারই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।)


রথে আরোহণ করেছেন দুই যুগপুরুষ
মুখোমুখি কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন-
বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের জন্য রাধেয়,
ব্রতী ছিলে সেবায়,
ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বসকল শিখেছ।
কুমারী কন্যার কোলে দুই প্রকার পুত্র জন্মায় জেনেছো
এক হয় কানীন, দুই সহোঢ়।
কর্ণ তুমি কানীন পুত্র ও ধর্মানুসারে পান্ডুর...
অতএব তুমি রাজা হও।
ব্রাত্য নও।
পিতৃ পক্ষীয় পান্ডবগণ ও বৃষ্ণিগণ মাতৃ পক্ষীয়
তোমার সহায়।
মহামায়াময় কৃষ্ণ আহ্বান জানায়-
পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর অভিমুন্যুসহ পাঁচ পুত্র
জানুক সকলে, সমাগত সকলে পদানত হবে। মিত্র
রাজা, রাজকন্যারা তোমার অভিষেকের জন্য
হিরণ্ময় রজতময় ও মৃন্ময় কুম্ভ ও বীজ রত্ন প্রভৃতি উপকরণে ধন্য।
দ্রৌপদীও ষষ্ঠ কালে তোমার সাথে মিলিত হবে,
যুধিষ্ঠির যুবরাজ হবেন, শ্বেত চামর হস্তে তোমার পশ্চাতে থাকবে,
ভীম মস্তকে শ্বেত ছাতা, অর্জুন চালাবে রথ,
অভিমন্যু সর্বদা থাকবে পিছনে, এ যেন ইমারত।
নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, পাঞ্চালগণের মন
মহারথ শিখন্ডী করবে তোমার অনুগমন।
কৃষ্ণের জ্ঞান চেতনা, তা সৌহার্দ্যপূর্ণ-কর্ণ কার্যকরী করে
ন্যায়শাস্ত্র মতে পান্ডুর পুত্র, সমস্তই মনে ধরে।


কর্ণ বলেন –
সূর্য ঔরসজাত কুম্ভীগর্ভে ধারণ করেও হিতচিন্তাহীনভাবে করে ত্যাগ
সূতবংশীয় অধিরথ ও পত্নী রাধার স্তনদুগ্ধের পেয়েছি ভাগ।
কি করে তাঁর পিন্ডলোপ করতে পারি?
আমি যে তাকেই পিতা মনে করি।
তাঁর জাতকর্মাদি, নিযুক্ত ব্রাহ্মণরা নাম দেন বসূষেণ
তাঁর আশ্রয়ে যৌবনলাভ, করেছি বিবাহের কার্যকারণ,
পত্নীদের সাথে প্রেমমিলনে এসেছে পুত্র-পৌত্রও,
গোবিন্দ, সমস্ত পৃথিবী ও বিপুল সুবর্ণ করতে পারে না সম্বন্ধও,
সুত লোভ বা ভয় পেয়েও পিছু হাটব না;
তেরো বত্সর নিষ্কন্টক রাজ্যভোগ, দুর্যোধন দিয়েছে প্রেরণা।
সুতগণের সাথে বহু যজ্ঞ করেছি, বিবাহাদি সম্বন্ধও আছে,
আমার ভরসাতেই দুর্যোধন যুদ্ধের উদ্যোগ করেছে,
অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা রূপে আমায় করেছে বরণ
মিথ্যাচারে করব না বিশ্বাস হরণ।
মধুসূদন, তুমি গোপনে রেখো একথা,
ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিক জানতে পারলে, রাজ্য নেবেন না যথা।
যদি আমিই রাজ্য পাই তবে দুর্যোধনকে করব সমর্পণ
যুধিষ্ঠিরই পাক, অর্জুন যোদ্ধা, হৃষীকেশকে করলাম অর্পণ,
ত্রিলোকের পূণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে বিশাল ক্ষত্রিয়মন্ডল
অস্ত্রযুদ্ধে নিহত ক্ষত্রিয়ই যেন স্বর্গলাভ করেন সম্বল।
এ এক অমোঘ পৌরুষের টানে
অচলায়তন রাধেয় নিয়েছে মেনে।
হাওয়া জীবনে মায়ের টান
গৌরবের মান, সম্মানের স্নান।
আজ কৃষ্ণ ধর্মপ্রতিষ্ঠাকে করছে কর্ষণ
যেন মহাকাল ও প্রকৃতির অশ্রুবর্ষণ।
কৃষ্ণ মৃদু হাস্যরসে বলেন, রাজ্য দিতে চাই নিলে না
পান্ডবরাই জয়ী হবে, ভুল হবে না।
ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচার্যকে ফিরে জানিও,
অগ্রহায়ণ অতি শুভকাল, শীত বা গ্রীষ্ম মানানসইও
পশুখাদ্য ও ইন্ধন সুলভ, শস্য পরিপুষ্ট, বৃক্ষ ফলবান
মক্ষিকা স্বল্প, কর্দমহীন, জল স্বাদু, সকলেই লাভবান।
সাতদিন পর অমাবস্যা, সেই দিন সংগ্রাম আরম্ভ হোক
যুদ্ধের জন্য সমাগত রাজাদের অভীষ্ট পূণ্য হোক।
দুর্যোধন অনুগামীগণ রাজা ও রাজপুত্রগণ
অস্ত্রাঘাতে নিহত হয়ে করবে স্বর্গ গমন।


কর্ণ বলেন,
মহাবাহু, সব জেনেও ভোলাতে চাইছো কেন .. বিশ্বরূপ
পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি নিমিত্ত স্বরূপ
স্বয়ং স্বপ্নে দুর্লক্ষণ দেখেছি, তুমি রুধিরাক্ত পৃথিবীকে নিজেই করছ নিক্ষেপ
তোমার প্রদত্ত পৃথিবী গ্রাস করছেন, এটাই আক্ষেপ।
কৃষ্ণ জানান, তার কথা হৃদয়ে প্রবেশ না করায় পৃথিবীর হবে বিনাশ,
এক গভীর মায়াময় দীর্ঘশ্বাস।
কর্ণ জিজ্ঞাসু, বলেন মহাযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে ভগবানকে দেখতে পাবে সে?
হয়তো যুদ্ধের শেষে স্বর্গে মিলন হবে...
শুধু কর্তব্যবোধ, বন্ধুত্বতার প্রতিজ্ঞার দাম
মৃত্যু পথেই মহারথীকে জানাবো প্রণাম,
কর্ণ-কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন করে রথ থেকে নেমে
নিজের রথে দীন মনে প্রস্থান করে, জীবনক্রন্দন থামে
আসন্ন ধর্ম প্রতিষ্ঠানের যুদ্ধ দুঃখে
কৃষ্ণ ও সাত্যকিকে নিয়ে শীঘ্র যায় অভিষ্ট মুখে।