ঢাকা ম্যাডিকেল কলেজের কংকালঘরে
নমিতা ঝুলছে দেহ-কংকাল হয়ে।
নাহ, নমিতার ঝুলন্ত পা'য়ে
ঘুংগুর জড়ানো নেই
নেই ছিন ছিন ছন্দে হেটে চলা সেই
চপলা কিশোরীর  নুপূর।


বক্ষ পিঞ্জরের হাড় পর্যবেক্ষণেও বুঝা যাচ্ছে না;
নমিতার কান্না।
নমিতা যখন নিঃশব্দে কাদতো, তখন তার বুকের খাচাটা ফুলে ওঠতো; পাখি পুষবার খাচার মত!
যেখানে যত্নে পুষে রাখতো তা'র পুষণ পাখি,
মন পাখি যাকে নিত্য শোনাতো;নীল মুনিয়ার গান।


সন্ধানী'র কাছে নমিতা নিজেই একদিন এসে, কাগজে-কলমে লিখে,স্বেচ্ছায় তার নিজ দেহটিকে দান করে গেছে! দস্তখত করতে যেয়ে রুকাইয়া ম্যাডাম সেদিন বলেছিলেন,
             -"আমাদের সংগ্রহে কোন দীর্ঘাকায়া নারীর কংকাল নেই! আপনার মৃত্যুর পর কংকালটা পেলে স্টুডেন্টদের পড়াতে সুবিধা হ'তো!
আর এ বয়সেও এখনো যেহেতু শরীরের কোথাও কোনও অসুখ ধরেনি, মৃত্যুর পর খুব দ্রুত ভিসেরাগুলো সংগ্রহ করে নিতে পারলে ভালো, অনেকগুলো রোগীর দেহে ভিসেরা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যেতো।"


ম্যাডিকেল স্টুডেন্টসদের কাছে ডঃ যখন কংকালটি ধরে ধরে এর বিভিন্ন হাড়গোড়ের নাম শেখাবেন, কেউ জানবে না; নমিতা স্পর্শে থেকেও কেন এবং কিভাবে ছিলো অধরা।
এও জানবে না; নমিতার জীবনে অনেক না পাওয়ার মাঝে পাওয়া ছিলো- একজন একান্ত আপন মানুষকে না পাওয়ার; নিরন্তর যন্ত্রণা!


নমিতার একাকীত্বের যন্ত্রণার ক্ষত, আর সব হৃদয়বিদারক কষ্টের চিহ্নকে করেছে গত।
কখনো কেউ তাই জানতেও পারে-নি,
নিরলস শ্রমে হাড়ের ক্ষয়ের পাশাপাশি;
তার মন-ও ক্ষয়ে গেছে কতখানি!


মেরুদন্ডের কশেরুকাগুলোর ক্ষয়ে;একত্রে মিলিয়ে যাওয়ার হিসেব বলে দেবে-; তার স্বামীর সাথে সহবাসের সে-কী করুণ ইতিহাস!
বলে দেবে; তাকে কাজ থেকে কেউ কখনো যে রেহাই দেয়নি, বিশ্রাম জোটেনি।
অথচ যতবার কেউ তাকে কাছে ডাকতো, ততবারই
তার মনে হতো; এই বুঝি সে আদর দিতে কাছে ডাকবে!
আগ্রহ ভরে কেউ নমিতাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে এলে; সে ভাবতো, মানুষটা তার জীবনে বুঝি বিশেষ কোন জন!
বিশেষ আর মিলবে কী!
সাধারণই যেখানে জোটেনি!


কংকালের আখ্যান বলে,
ওরা আসতো; নমিতাকে নিয়ে যেতে,
কাখে তুলে দিতে জল ভরা কলস, ডেকচি।
স্থুলকায় শিশুকে কোলে তুলে দিতে; জোর করে!
যা কী-না টেনে নিতে, বয়ে বেড়াতে অন্য কেউ কখনো রাজী হতো না, নমিতাই শুধু হাসিমুখে তার ভার বয়ে যেত!
ক্লান্ত শরীরে প্রশান্তি দিতো তার বড় চাচী আম্মার কন্ঠে বাংলা সিনেমার গান। বড় চাচার ফরসি হুক্কার গর-গর শব্দ বুঝিয়ে দিতো; বড় চাচাও চাচী আম্মার গানের সমঝদার।


কাচের বাক্সবন্দী নমিতার মনহীন, মাংসহীন নিরেট কংকাল সাক্ষী,
মাংসের তালায় চাবি ঘুরিয়ে যে সুখের বিশ্ময়,   তার চেয়েও অধিক অবদান রাখতে জানে- দেহদানে।
নমিতার দেহ-কংকাল তাই নিবেদিত, মানব-কল্যাণে।