অবিশ্বাস্য এক ভোরে নীলের জ্যোৎস্নায় মেঘজাল কেটে সূর্য ফুটলো । এমন একটি রাত পেরিয়ে যখন নিঃস্ব জরা চোখে তাকালাম, ঝলসে যায় দু'নয়ন । সেই ছাইরঙা নয়নের চিকিৎসা হয় নি । কোন ডাক্তার বলে নি তারা বাধ্য, মানবিকতার বাক্সে কখনো তারা দস্তখত করে নি । আলোহীন সেই আপনদ্বয়কে নিয়ে নি:শব্দে ঢুকে গেলাম বিদীর্ণ আরেক রাতের যাত্রী হয়ে। এই এক আশ্চর্য রাত- যেখানে কোন আঁধার নেই, নেই কোন আবেগী ধ্বংসলীলা ! শুধু আলোহীন আমি, এই হৃদয়ও আসবাবহীন চৈতন্যহারা ঘরে উন্মুক্ত হওয়ার স্বাদ গলা ছিঁড়ে গ্রহণ করছিলো ! কে তাকে স্বাধীন করে দিলো !


একটা আয়না, বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছিল কুক্ষিগত শিরা । না, আমি দেখি নি সে আয়না, সেই নয়ন তো আমার নেই ! সে কাছে এসে মগজ খুলে বললো, আয়নায় কী দেখবে তোমার সুকেশী জোনাকজ্বলা নয়নদ্বয় ?, বলে সে বিকট এক হাসি দিল, যার জন্য প্রস্তুত ছিল না নির্জীব এই দেহ। সে আওয়াজ সুঁইরূপে এই ভঙ্গুর অস্থিমজ্জা ভেদ করে বেরিয়ে গেল । কিছু যন্ত্রণার গন্ধ উগ্র মাতাল কান্নায় ঘিরে ধরলো । ভাবি নি তারা এই আঁধারবিহীন রাজ্যেও আমার দেখা পাবে, তারা তো আঁধারের সুকথিত বাসিন্দা ! অবাক করে দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড চিবিয়ে অবশিষ্ট ঘ্রাণ গায়ে মেখে তারা গায়েব হয়ে গেলো, ঠিক বুঝে উঠার খুব আগে ! কৌটাসমেত কিছু ঘ্রাণ সযত্নে রেখেছিলাম খুব গোপনে, যে ঘ্রাণে কিছু বিদায়ী স্বপ্ন মেখে আলোহীন রাজ্যে ছাইরঙা নয়ন জোড়ার মালিক হলাম ! অথচ সেই ঘ্রাণ বিন্দু মুহুর্তেই নিমেষে ডাকাতি হয়ে গেল ! আছে কী তবে এই এলোমেলো চৌকাঠের জীবন্ত ঘরে ?


একদল অদৃশ্য নৃত্যশিল্পী আমাকে বিনম্র চিত্তে গান শোনাচ্ছে, সজাগ ইন্দ্রিয় চারপাশে সুর খুঁজছে । তাদের নৃত্যে হাজারো বিলম্বের নিমগ্ন রাগ, যার জন্য হয়তো আমার কখনো আভাস পাওয়ার কথা ছিলো না । তবে কী নতুন কোন উদ্যানে স্বাগত আমি ? সকল প্রশ্ন ছিন্ন করে একটি ভেলা এসে থামলো থমকে জেগে উঠা নির্জীব এক সৈকতে, যার দ্বারপ্রান্তে অযাচিত কান্নায় এসে পড়েছি একঝাক পাখির চেনা সুর বেয়ে । সে সুর আর কখনো নির্লিপ্ত আকাশে বাজে নি, হয়তো দিকভ্রান্ত পাপে হারিয়ে ফেলেছি, হয়তো দৃষ্টিভ্রম । নির্জীব সৈকতের নিরাসক্ত ভেলা সযত্নে এঁকে আসা আমার সকল পদচিহ্ন চিরতরে মুছে দিলো । আমায় নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে তির্যক স্রোতের সমাপ্তহীন নিষিদ্ধ তিমির জলপল্লী । খসে পড়া ছাইরঙা নয়নের মুক্ত কোটরের দরজা বন্ধ করে হাতদুটো বিস্তীর্ণ অবয়বে প্রসারিত করে দিলাম সময়ের বেদনার্ত শিরচ্ছেদ সম্পন্ন করে । অশ্রুরৌদ তীব্র রোষাগ্নিতে আমায় গলে নিয়ে যাচ্ছে বিলীন হওয়ার সুপ্ত আবাসে, পেছনের সকল নৃশংস দৃশ্যপট ভেঙ্গেচুরে ।


অবশেষে সেই ভেলায় আমার হৃদপিণ্ড পতাকা উড়িয়ে দিয়ে চিরতরে শান্ত করে দিলাম তোমাদের হৃদয়, সেখানে অযত্নে জমে থাকা কিছু রক্ত আর কখনো খুঁজে পাবে না....