(বড়দের মুখে শুনেছি -অবিভক্ত বাংলায় ধর্মের সুড়সুড়ি ছিল না। যে যার বিশ্বাসে অবিচল থেকেও পারস্পরিক সম্পর্কের এক গভীর আত্মীয়তায় বাস করতো বাঙালি সত্ত্বা (হিন্দু-মুসলমান )। নজরুল যথার্থই লিখেছিলেনঃ "আমরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম..."। বাঙালির দুর্ভাগ্য, পাকিস্তানের মদতপুষ্ট রাজাকারদের অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ বাঙালি পশ্চিম বাংলায় শরণার্থী হয়। সরকার কিছুটা লোক দ্যাখানো পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেও তা ছিল নগন্য। তাছাড়া ১৯৭১(কাট অফ ডেট)-এর পরে আসা বাঙালিরা আজও অবহেলিত (বাংলু নামে তিরষ্কৃত)। সেই সব উদ্বাস্তু বাঙালিদের উদ্যেশে এই কবিতা রচিত ও উৎসর্গীকৃত... )
....................................................................


কবে কবে সব কথা হয়ে গেল,একান্তই যা নিজের;
বলতে পারি না, না বলে থাকার দুঃখ বেদনা কী যে!
আমি একা বুঝি আর বোঝে সেই ভুক্তভোগীরা ; সীমা
পেরিয়ে যে সব মানুষের মতো অবয়বে থাকা প্রাণী
পালিয়ে বেড়ায় আনাচে কানাচে; নিয়মের জাঁতাকলে
আঁটকে পড়েছে। আমিও রয়েছি একান্তে ওই দলে।
তবু অভিনয়! - লজ্জাশরম, ভয়ভীতি আছে মনে
-কে কেমন করে তাকাবে কে জানে?
                                        কখনোসখনো দেখি
বিশেষ শব্দ উচ্চারণের আড়ষ্ঠতার দায়ে
বন্ধুমহল প্রশ্ন করেছেঃ ওপারে কি ছিল বাড়ি?
সন্তর্পনে মা-বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি বোঝা।
আমি একা একা নিজেকেই নিজে
                                 গালি দিতে দিতে বলিঃ
বেয়াকুব! আজও ভাষা শিক্ষাটা অপূর্ণ থেকে গেছে ।


যে ভাষা আমার রক্ত প্রবাহে, যে পাঠ আমার মনে
এনেছে সকাল, ঝড়ঝাপটায় যে মাটির কাদাজলে
আছাড় খেয়েছি; নাও বেয়ে গেছি উচ্চ বিদ্যালয়ে,
আয়েষা-শ্যামলি-সাজিদ-বিভূতি একসাথে খেলাধুলা
একসাথে বেড়ে ওঠা ছেলেবেলা, একসাথে কৈশোর।
যে ভাষা আমার নিবের ডগায় প্রথম কবিতা আনে,
যে মাটি আমার হামাগুড়ি দেয়া স্মৃতি সম্ভারে গাঁথা ,
যে মাটি আমার মায়ের প্রসব বেদনার আশ্রয়,
যে তরুলতার বাঁধনে আমার অন্তরে আসে গান
যে মাঠে আমার বাবুইপাখির-বাসা বাঁধা ফুটবলে
প্রথম খেলার মারাদোনা দৌড়, -চোট পাওয়া, যন্ত্রনা।
যে প্রতিবেশীর উঠোনের পাশে আমগাছে, কুলগাছে
আমি আজও উঠি স্বপ্নমেদুর, বুড়িমা'র চ্যাঁচামেচি
কানে ভেসে আসে; কখনও আদরে
                                        পায়েশের বাটি হাতে
তুলে দিয়ে দেয় উপদেশ,
                         -আজও চোখ ভরে আসে জলে।  
আজও ঘুড়ি ওড়ে আকাশে আকাশে ,
                                          আমার হাতের যাদু
সুতো মারফত নির্দেশনামা পাঠায় ঘুড়ির কানে।
আমার শরীরে, মনে, চিন্তনে, স্বপ্ন-সাধনা জুড়ে
যে মাটি,যে ভাষা,তাকে ভুলে যেতে এ কোন  
                                                   তৎপরতা?


তৎপরতার কারণ রয়েছে; ভালো থাকা কে না চায় ?


কামার,কুমোর,তাঁতি,জেলে যত রাজমিস্তিরী, কুলি,
চাকরবাকর, ভ্যান-রিক্সার চালক,কাজের মাসি,
ফুল-বেচা হতদরিদ্র যত সধবা-বিধবা-বুড়ি,
ওদের সহজে চেনা যায়, যত অবজ্ঞা অনায়াসে
ওরা নিতে পারে; উদ্বাস্তুর পোশাকেই ওরা দুটো
ডাল-রুটি পেলে বেঁচে থাকে, কচি ছেলেমেয়ে অনাদরে
বাবুর বাড়ির এঁটোকাটা খায় -কাজ করে লাথি সয়ে!
হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছুটে যায়, পাশে শুয়ে থাকে ওরা।
ওরা অপরাধী! আদিপুরুষের চাষবাস, ভিটেমাটি,
ফলের বাগিচা, সারি শালখুঁটি, দোতলা ঘরের মায়া
কাটিয়ে এসেছে -সব ছেড়ে শুধু নিঃস্ব হবার লোভে!


আমি একান্তে ওই দলে; তবু পোশাকের ঘরে বসে
দৃষ্টি কিছুটা দুর্বল তাই চশমা লাগিয়ে চোখে
অন্যরকম দেখি চারিদিকঃ ব্যবসা-চাকরি, নানা
বৈভবে ভাবি ছেলেমেয়ে হোক বড়কিছু, হোক ভালো।


পরিচয়-হীণমন্যতা নিয়ে ওপরে গেলেও কিছু
অদৃশ্য হয়ে থাকে ভর্ৎসনা, থাকে দয়া, পরিহাস;
থাকে ভাষা-বিদ্রূপ, হাসাহাসি  
                                     - সহনীয় নয় মোটে।


তৎপরতার কারণ রয়েছে; আমি চাই ভালো থাকি।


পৃথিবীতে কারা ভালো আছে, কারা ভালো নেই
                                                  সে খবরে
কার এসে যায়? স্বদেশ আমার রত্নপ্রসবা বটে!
ভারতরত্ন, বঙ্গরত্ন; রত্নে রত্নে দ্যাখো
ছড়াছড়ি কত পদ্মভূষণ বিভূষণ-বিদুষণে!
তোমার খবর রাখার সময় মহামানবের হাতে
কোথায়? ওরা তো দেশ গড়ে তোলে
                                  দেশ করে তোলে আলো!
অনুপ্রবেশের দায়ে তবু ওরা তোমাকে তাড়াচ্ছে না;
কাট অফ ডেট-এর পরে এসে তুমি
                                     কেন পাবে অধিকার?


তবু তোমাদের মৃত্যু এখনও হয়নি, তোমরা পারো
মৃত্যু-দুয়ারে কাঁটা দিয়ে ধু ধু সুউচ্চ ইমারতে
ওঠার লড়াই লড়ে যেতে, পারো স্বপ্নের আরাধনা।
বঙ্গভঙ্গ রুখে দিতে পারো, ব্রিটিশের রাঙা চোখে
চোখ রেখে তুমি পারো সত্ত্বার রক্ষার বাহাদুরি।
শুধু যা জানো না -স্বজনের সাথে প্রণান্ত লড়ে লড়ে
কী করে আত্ম-অধিকার কেড়ে নিতে হয় ছলেবলে,
কৌশলে। শুধু স্বার্থের টানে এই জঘণ্য কাজে
তুমি অপারগ। অগত্যা তুমি কিনেছ রেশনকার্ড!
-দ্বিতীয় জন্ম নিয়েছ আবার টাকা ঢেলে অকাতরে।


তোমার থালায় উঠবে না আর সুগন্ধি ফ্যানাভাত,
উঠবে না আর পৌষের শেষে অযাচিত ভাপাপুলি,
তোমার ইলিশ আর কোনোকালে
                                ফিরে আসবে না পাতে,
তোমার জমিতে ফলবে না আর আউশ-আমন-বোরো,
তবুও তোমরা পারো, অসহায়, লড়াই করতে পারো।


বিদেশিরা এলে দেখি সাগ্রহে আমার বন্ধুগুলো
আলাপচারিতা করে মজা পায়, এলোমেলো ইংলিশে
বুক ফুলে ওঠে, বাড়ে গৌরব
                                       -মানমর্যাদা বাড়ে!
তুমি ওই দলে পড়বে না, তুমি বিদেশির সম্মান
পাবে না। তুমি তো বাঙালির কাছে বাঙালিও ঠিক নও।


গল্প-কবিতা কত লেখা হয়, আবেগতাড়িত গানে
কত জুড়ে যায় এপার ওপার; ইছামতি নদী জুড়ে
ওঠে দূর্লভ যোগাযোগ সেতু, সীমান্ত-কাঁটাতারে
জং ধরে যায়,তবু কল্পনা তোমাকে বলছি, শোনো;
এমন হওয়াটা জরুরি অথচ এমনটা কোনোদিনও
হবে না; বাংলা-মায়ের শরীরে সেলাইয়ের কারিগর
পাবে কোনখানে? বাংলা এখন হাঙরের করতলে।
আবাদের দেশে মৌলবাদের বিষ-বৃক্ষরা আজও
আছে বিস্তর; মানুষের ঘর ভেঙে যায় দ্রুত ঝড়ে।
বাঙলা মায়ের কোটি সন্তান দাসদাসী নিজ দেশে।


জাগো বাঙালিরা, সূর্য সেনের বংশধরেরা জাগো;
বিনয়-বাদল-দিনেশের দেশে পরমহংস জাগো,
জাগো মুজিবর রহমান আর ফরহাদ মজহার,
নরাধম নও তুমি নরেন্দ্র বিবেক-পর্যটনে,
তুমি লালনের স্বপ্ন-লালিত বিশ্ববাণীর দূত,
তুমি সুনীলের স্তব্ধ বেদনা; শামসুর রাহমান;
রফিক-সফিক-সালামের তুমি যোগ্য রক্তবাহ;
তুমি জীবনের পরম সাধনা -অন্নদাশংকর।
জাগো বাঙালিরা জননীর কোলে
                                শিশু হয়ে জেগে ওঠো...