অন্ত্যমিল কবিতার প্রাণ নয়; কবিতার প্রাণ হল তার ধ্বনি প্রবাহ, শ্রুতিতে যার প্রকাশ শব্দ হিসেবে। অন্তত আমার এরকম বিশ্বাস। বাংলা সাহিত্যে ছন্দের যে তিনটি প্রধান ধারা সর্বজন বিদিত, তাতেও কিন্তু অন্ত্যমিলের আবশ্যিক কোনো শর্ত নেই। অমিত্রাক্ষর ছন্দ তো একেবারেই অন্ত্যমিল বিবর্জিত। যদিও সনেটে নানা ধারার অন্ত্যমিল নানা কবির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, বেশ কিছু কবি অমিত্রাক্ষর সনেটের পরীক্ষাতেও কিন্তু সফলভাবে উত্তীর্ণ। বিশেষ ধরণের অন্ত্যমিল কবিতার জন্য যে অপরিহার্য নয় তার প্রমান হিসেবেই একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। কবি সম্মেলনে পাঠ করে দেখেছি কবিতাটি বেশ সম্মানের সঙ্গে উতরে গেছে, শ্রোতাদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। কবিতাটি আসলে দু'লাইনের অন্ত্যমিল ও মুক্ত ছন্দের এক সার্থক খিচুড়ি! চার-লাইনের মধ্যে সব  ধরনের অন্ত্যমিল এ-ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে ( সভ্য সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে তিন-এর মিলন স্বীকৃত নয়। সুতরাং প্রতি তিন লাইনের অন্ত্যমিল এ ক্ষেত্রে আমিও এড়িয়ে গেছি কারন আমি বিশ্বাস করি, কাব্য মূলত আমাদের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, জীবন ও দর্শনের এক সার্থক প্রবাহ)। কবিতাটি সুহৃদ পাঠকের গোচরে আনার আগ্রহে নীচে রাখছিঃ


গভীরে তোমার সুখের কতো যে বিচ্ছুরণ!
দুঃখও করে সম-অধিকারে বসবাস;
আলোকে যেমন কাছে টেনে নাও আন্তরিক,
আঁধারও তেমনি ঠাঁই পেয়ে গেছে অনায়াস।


শরীরে তোমার যেমন জেগেছে পঞ্চবাণ,
যেমন জেগেছে শরীরে তোমার রিরংসা,
তেমনি জেগেছে মানবিকতার প্রশংসা,
তেমনি জেগেছে জিতেন্দ্রিয়ের পরম-ধ্যান।


শরীরে তোমার যেমন জেগেছে প্রভঞ্জন,
জেগেছে যেমন ভুবন কাঁপানো অট্টহাস,
তেমনই জেগেছে মহামানবিক কোমলতা,
তেমনই জেগেছে গভীরের বানী- নবজীবন।


তরঙ্গ-শোভা মনে জাগে দেখে সমুদ্দুর,
অদূরে মৌন দাঁড়িয়ে রয়েছে মেদিনিধর;
অন্তরে জাগে মহাজাগতিক অচেনা সুর,
অরন্য, নদী দৃষ্টিতে জাগে পরস্পর।


বড় বেদনায় বুকে ধরে রাখো অষ্টনাগ!
বড় বেদনার ক্ষত হয়ে আছে বলাৎকার;
তাই কি তোমার দিন কেটে যায় রুদ্ধবাক,
তাই কি তোমার দুচোখ ভরেছে অশ্রুতে?


প্রতিদিন আমি তোমাকেই দেখি সবিস্ময়,
রাত কেটে যায় তোমার নিবিড় বন্ধনে;
জাগ্রত তুমি, প্রকাশিত তুমি নিরন্তর,
তুমি সৃষ্টির ফসলের মতো মৌন-স্বর।


অন্তরে তুমি জেগে আছো হয়ে  কাব্য-রূপ,
মহাজাগতিক ধ্যানে শব্দরা হয়েছে চুপ।
গভীরে তোমার সৃষ্টিকালিন স্তব্ধতা,
বুকে ধরে আছো অনাদিকালের সারাৎসার।


তুমি শিখিয়েছ অর্থেরও আছে নানার্থ;
তুমি শিখিয়েছ অনর্থ নয় অর্থহীন;
পিপাসুর কাছে প্রত্যহ তুমি অর্বাচীন,
-যুগযুগান্তে আকর গ্রন্থ; আলোকময়।


এই ভালো, নিয়ে বসে থাকি বুকে, অনর্গল
কথা কয়ে যাও, কথা বস্তুত কাঙ্খা-ফল;
এই ভালো, নিয়ে বসে আছি বুকে, আন্তরিক,
-কথোপকথনে আলো হয়ে যাক দিগ্বিদিক।  


তুমি আছো তাই জগত ভরেছে সুরসুধায়,
আমিও পেয়েছি কাঙ্খিত শত অন্ত্যমিল;
স্তোত্র-মালার প্রতি পুষ্পিত আলেখ্যে
জাগ্রত তুমি- চির নমস্য শব্দ-প্রাণ।


( অন্ত্যমিলের ধরনঃ ২,৪। ১,৪;২,৩।১,৪।১,৩;২,৪। ১,৩। ৩,৪। ১,২।২,৩।।১,২;৩,৪। মুক্ত ছন্দ।