**********
                  কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতায়  নারী দেহের শারীরিক বৈশিষ্টের প্রভূত উল্লেখ আছে এবং মনজ প্রেমের চাইতে দেহজ প্রেমের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু তাঁরই সমকালীন পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্ত্তীর কবিতায় নারী প্রেমের আভাস খুবই সামান্য  পাওয়া যায়, নারী দেহের সৌন্দর্য্যের আকুলিত বর্ণণা তাঁর কবিতায় বা লেখায় প্রায় একেবারেই নেই বলা যায় - যা বেশ লক্ষ্য করা যায় কবি জীবনানন্দের কবিতায়ও, তেমনি অবশ্যই বুদ্ধদেব এর কবিতায় ।

                 কবি অমিয় চক্রবর্ত্তীর সৃজনশীলতার সাথে বিদগ্ধ সাহিত্য আলোচকেরা ইংরেজ কবি হপকিন্স এর সাথে তুলনা করেছেন - যদিও এই দু'জনের মধ্যে আমি একটি বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করি, তা হলো - হপকিন্স ছিলেন ধর্মযাজক এবং তাঁর কবিতায় ঈশ্বর চিন্তা বা গভীর আধ্যাত্মিকতা প্রবলভাবে বিদ্যমান, কিন্তু কবি অমিয় চক্রবর্ত্তীর কবিতায় গভীর দার্শনিক মননশীলতার সাথে মৃদু আধ্যাত্মিকতা দেখা গেলেও মুলতঃ তিনি ছিলেন ঈশ্বর বিশ্বাসবর্জিত আধুনিকমনষ্ক কবি -তাই তাঁর কবিতায় যে আধ্যাত্মিকতা তা মূলতঃ ঈশ্বর অস্তিত্ত্ববিহীন আধ্যাত্মিকতা- যা দার্শনিকতাপূর্ণ জীবনবোধের গভীর অনুভবের জটিল প্রকাশ মাত্র ।  

                  সকলেই জানেন যে, কবি অমিয় চক্রবর্ত্তী দীর্ঘদিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্বকবির সাথে নানান দেশেও ভ্রমণ করেছেন । কবি অমিয় চক্রবর্ত্তী'র একটি ভারী কৌতুহলোদ্দীপক কবিতা 'বড়োবাবুর কাছে নিবেদন'। যাঁরা আগে পড়ার সুযোগ পাননি তাঁদের জন্যে শেয়ার করলামঃ

অমিয় চক্রবর্তী’র কবিতা
“বড়োবাবুর কাছে নিবেদন’
________________
তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-
হই না নির্বাসিত-কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।
তাড়াও সংসার,রাখলাম,
বুকে ঢাকলাম
জন্মজন্মান্তরের তৃপ্তি যার যোগ প্রাচীন গাছের ছায়ায়
তুলসী-মন্ডপে, নদীর পোড়ো দেউলে, আপন ভাষার কন্ঠের মায়ায়।
থার্ডক্লাসের ট্রেনে যেতে জানলায় চাওয়া,
ধানের মাড়াই,কলা গাছ,কুকুর,খিড়কি-পথ ঘাসে ছাওয়া।
মেঘ করেছে, দু-পাশে ডোবা, সবুজ পানার ডোবা,
সুন্দরফুল কচুরিপানার শঙ্কিত শোভা,
গঙ্গার ভরা জল; ছোটো নদী;গাঁয়ের নিমছায়াতীর-
হায়,এও তো ফেরা-ট্রেনের কথা।
শত শতাব্দীর
তরু বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী :
তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-
দূর-সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।।


                                         (চলবে)