**********
কবিতার আধুনিক যুগের সেই পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ও সম্ভবতঃ সমধিক মেধাবী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন দলের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম, ভিন্ন ধারার, গতানুগতিকতার  ঠিক উল্টো রকম ।
তাঁরই সতীর্থ কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, 'তিনি বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি। কল্লোল যুগের প্রধানতম কবির মুখ থেকে এমন সরল উচ্ছ্বসিত উক্তি কবি সুধীন্দ্রনাথের বিদগ্ধী সত্তাকে আগ্রহী পাঠকের চোখের সম্মুখে এনে দেয় সহজ প্রাপ্তির মতোই ।
জলভূমি'র ওয়েব ব্লগে শাহ ইয়াছিন বাহাদুর সঠিকই বলেছেন যে;
'রবীন্দ্রসাহিত্যের সুকঠিন বলয় ভেদ করে যে কজন কবি আপন আলোয় আলোকিত তাঁদের অন্যতম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সুধীন্দ্রনাথের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য, আকর্ষক তারল্যহীন ভাষাকাঠামো, ভাবের সুশৃঙ্খল অথচ পৃথক প্রকাশভঙ্গী। তাঁর কবিতার পরতে পরতে কাল অতিক্রমের সীমানা স্পর্শের ডাক, দুর্বোধ্য প্রেম, ঈশ্বরে সংশয়, আর নিজেকে আবিষ্কারের দুরূহ প্রচেষ্টা মূর্তমান। বাংলা কবিতার ধ্রুপদী রীতির তিনি প্রবর্তক।
২৪ বছর বয়সে ‘ছবি বসু’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার এক বছরেই বিচ্ছেদ ঘটে গেলে ১৯৪৩ সালে ‘রাজেশ্বরী দত্ত’র সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের আগ পর্যন্ত ১৮ বছরের সুদীর্ঘ একাকীত্বই সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় তাঁর হীরন্ময় কালটি এনে দেয়। যদিও প্রাথমিক কালে কিছুটা রবীন্দ্রনাথ ও আরেক ধারা-পরিবর্তক মাইকেল মধুসূধনের কিছুটা প্রভাব তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায় কিন্তু একটা সময় এঁদের পাশ কাটিয়ে তিনি প্রচলিত ধারার পরিবর্তন চাইলেন। প্রেমময় কিংবা বিয়োগান্তক, নিঃসঙ্গতা কিংবা অপারগতা, এর সবগুলো পরিচ্ছেদেই তিনি বাজাতে চাইলেন নতুন সুর। কবিতায় স্থাপন করতে চাইলেন ধ্রুপদী মূর্ছনা।'
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের লেখা আমার একটি প্রিয় কবিতা আসরের পাঠকদের জন্যে শেয়ার করলামঃ
সৃষ্টিরহস্য

আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে ;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে ;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী ।।

সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা ;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে ; জনহীন, অন্তর,বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে  কণ্টকিত আমার শরীর ;
অবচেতনার তলে গুমরে কী জাতিস্মর কথা?

তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত ;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত ?

নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা ?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা ?

নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্‌ময় জগৎ ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয় ;
হয়ত মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয় ;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ ।।

কপোল কল্পনা ত্যাগ ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা ; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা ;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই ; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা ;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন ।।


                                         (চলবে)