*********
             আজ থেকে কত বছর আগেই বলেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ,
                    ‘অদ্ভুৎ আঁধার এক নামে চারিধারে’
আজ এত্তোবছর পরেও সেই কথাটি কি অমোঘ সত্যি হয়ে তা’ ধরা দিয়েছে আমাদের এই সময়ের সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে – আমাদের এই সময়ের সমাজের জন্যে !!

                তাঁর মতো কবিরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হয়ে ওঠেন , তাঁদের কলম থেকে বেরিয়ে আসে কবিতা নামের জীবনসন্দর্ভ, সময়ের, কালের, সমাজের এক অবধারিত চিত্র । বাংলা ভাষায় সকল কবিদের মধ্যেই কবি জীবনানন্দ দাশ অনেক বেশীই স্বতন্ত্র, অনেক বেশীই বাঙ্ময়, অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ।

               তাঁর উপরে সুচিন্তিত মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যগবেষক জনাব সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, 'বর্তমানে পৃথিবী হচ্ছে বিজ্ঞানের এবং পর্যাপ্ত সামগ্রীর। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি অসম্ভবের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়েছে যার মধ্যে আমরা ব্যতিব্যস্ত এবং দিক-ভ্রান্ত। সমযের গতিবিধিও এখন হিসেব করা যাচ্ছে না— একটি অসম্ভব দ্রুততায় আমাদের বর্তমান সময় অতীতের অস্পষ্টতায় হারিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের পক্ষে কোনো বিশেষ সূত্রের মধ্যেই স্থিতিশীল হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। এ সময় যাঁরা কবিতা লিখছেন তাঁদের কবিতায় কোনো সুবিন্যস্ত বর্ণনা প্রস্তাবনা নেই, একটি অস্থির বিসংবাদের রেখাঙ্কন আছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বর্তমানকালের এই অস্থিরতার তত্ত্বকে তাঁর কবিতায় ব্যাখ্যা করেছেন। বিষ্ণু দের কবিতায় রূপকল্প, চরণবিন্যাস এবং কারুকর্মের মধ্যে যুগের অস্থিরতা প্রতিচিত্রিত হয়েছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ একটি বেদনাময় আত্মকেন্দ্রিকতায় আপন অস্তিত্বের চৈতন্যকে অনুভব করতে চেয়েছেন। তিনি পৃথিবীকে একটি একক অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করতে চেয়েছেন, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি এবং প্রাণী একাকার হয়েছে। মানুষ শুধুমাত্র আপন সামাজিক, সাংসারিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে উপস্থিত নয়, সে সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি এবং প্রাণীজগতের সঙ্গেও একটি বিশেষ আবহে একত্রিত রূপে উপস্থিত। আমরা আকাশ, মাটি, বৃষ্টি, নদী, পাথর, লতা, গাছের শাখা, স্থলচর প্রাণী এবং কলকণ্ঠের অনেক পাখি নিয়ে পৃথিবীতে বাস করি। এদের সঙ্গে অবশ্য আমাদের সংসার যাপন নয়, কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব যাপনের মধ্যে এরা সর্ব মুহূর্ত উপস্থিত। তাই জীবনানন্দ দাশ মানুষকে প্রকৃতির বর্ণবৈচিত্র্যের মধ্যে এবং প্রাণীজগতের অবিস্থিতির মধ্যে নির্ণয় করতে চেয়েছেন। নির্ণয় করার উপায় হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাদের সকল অনুভূতিগুলোকে উৎকণ্ঠিত করা। এই অনুভূতিগুলো হচ্ছে দৃষ্টির অনুভূতি, ঘ্রাণের অনুভূতি, স্পর্শের অনুভূতি, স্বাদের অনুভূতি এবং শ্রবণের অনুভূতি। মানুষের সজীবতার প্রমাণ এই অনুভূতিগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। একমাত্র ম্রিয়মাণ মুমূর্ষু ব্যক্তির কোনো অনুভূতি নেই। কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ তাঁর কর্তব্য ভেবেছিলেন এই অনুভূতিগুলোকে সকল বর্ণনার মধ্যে প্রমাণিত করা।' (আধুনিক কবিতা : শব্দের অনুসঙ্গে, পৃ-৩৯)

                    আকাশে কাতর আঁখি তুলে ঝরা পালকের ছবি দেখা সেই এক বিস্ময়কর কবি আমাদেরই বাংলাভাষার কবি, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা – ‘আমি কবি  - সেই কবি’ – আসরের পাঠকদের জন্যে দিলাম তুলে --  

কবি  জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা
আমি কবি– সেই কবি–
-------------------
আমি কবি– সেই কবি–
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!
স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা–
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!
ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,–
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!
বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প’ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!
                                                                        (চলবে)