***********
সুনন্দিতা –
গতকাল বিকেলে তোমার চিঠি পেয়েছি
তখনি খুলে পড়বার সময় ছিলো না – ;
কিউবার ছেলে লিয়েন আমার হাতে
তোমার সুগন্ধি মাখা পত্রখানি তুলে দিয়ে
একটু অর্থপূর্ণ মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখেছিল,
আমি তার হাসিকে উপেক্ষা করেছি অবলীলায় ।
ক্যাম্পে সবাই জানে, আমার কাছে প্রতি মাসে
একটি সুগন্ধিমাখা চিঠি আসে ।

আমি জানতাম না - উপেক্ষা কেমন করে করতে হয়,
তুমিই হাতে ধরে ধরে আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছ
তার মধ্যে অন্যতম একটি উপেক্ষা – ।
অবশ্য সেই লিষ্টের এককোণায় ভালবাসাও ছিল ।
আমি এখন চোখে চোখ রেখেই
উপেক্ষা করে যেতে পারি কত কিছুই ।
ভালবাসতেও হয়তো পারি –
কিন্তু এখানে তেমন ভালবাসার সুযোগ নেই
তবে সেবার সুযোগ প্রচুর আছে – সেবাওতো ভালবাসা
তুমিই বলো - সত্যি বলিনি ?

তুমি জানো, আমি এক অন্যরকম যুদ্ধে সামিল হয়েছি
একাত্তরে আমার যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার -
আমি হারিয়েছি আমার বাবা, মা, ভাই বোন সবাইকে
ফিরে এসে পোড়াভিটের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম
আমার ঝিনুক মাসি পেতলের থালায় ডালভাত  ও
একটি কাঁচা লঙ্কা এগিয়ে দিলেন
তোমার মাকে আমি ঝিনুক মাসি ডাকতাম
তুমি তখনো ফ্রক ছেড়ে
                 শাড়ীতে পৌঁছোনি ।

আমার আজকের যুদ্ধও তোমার অজানা নয়
সারা পৃথিবী জুড়েই এখন আমাদের যুদ্ধ
অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, অমানবিক হিংস্রতা
অবিচার, রাস্ট্রীয় আগ্রাসন, মৌলবাদীতা, ধর্মীয় জঙ্গীবাদ
এই সব কিছুর বিরুদ্ধেই আমাদের যুদ্ধ –
এই যুদ্ধ কোন সহজ যুদ্ধ নয় সেও তুমি জানো –
কারণ শত্রু যে আমাদের ঘরেরই লোক – !

মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে -
স্বাধীনতার বয়সও অনেক হলো –
তবু আজো হাজার রকম পরাধীনতায় মানুষ কাঁদে
মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের যে যুদ্ধ
তার শেষ কবে সেতো আমরা কেউওই জানিনা
আমার বন্ধু আনোয়ারকে তোমার মনে আছে?
যে নিজের প্রাণ দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল ।
সে মৃত্যুর আগে আমার হাতে একটি চিঠি দিয়েছিল
সেই চিঠিও তোমার চিঠির সাথে একাকার হয়ে
আমার বুক পকেটে যত্নে লুকোনো আছে ।

সুনন্দিতা –জানতে চেয়েছো কবে ফিরবো আমি !
কখন আমাদের যুদ্ধ শেষ হবে সেতো জানিনা
তবে আমি প্রতি রাতেই তোমার কাছে -
আমাদের পোড়াভিটের আকাশে ফিরে ফিরে আসি
তুমি কি টের পাও ? – আমার বুকের পুরুষালি গন্ধে
তোমার মহুয়া মাতাল দিন আমি কি ভুলতে পারি বলো !
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু – আমি আসবো একদিন
আমি ঠিক আসবো তোমার কাছে – ।

যেদিন বোকা হারামী নরপশুদের হাত থেকে
অসহায় মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতে পারবো,
যেদিন মালালার হাতে একটি নিরাপদ ভূমি দিতে পারবো
যেদিন পৃথিবীর কোথাও একটি মানুষও
                   আর ধর্মীয় উগ্রতার বলি হবে না;
যেদিন তসলিমা ফিরে পাবে নিজের মাতৃভূমি
যেদিন এই পৃথিবীর সবাই বন্দুক, মিশাইল ছেড়ে
ফুল ও পাখি ভালবাসবে, আকাশ ও বৃষ্টি ভালবাসবে
যেদিন ভালোবাসায় ও মমতায় ভরে যাবে মানুষের হৃদয়
আমি ঠিক আসবো ফিরে সেইদিন – তোমারই কাছে ।

                ---০---