শুধু বাঙালীদের অবস্থানের জন্য নয় বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্যের এক সুনির্মল সূতিকাগার হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে তৃতীয় বাংলা বলে সুদীপ্ত ঘোষণা দিচ্ছে আজকের বাঙালী অধ্যুষিত ব্রিটেন।
ঘরকুনো হিসাবে পরিচিত বাঙালীরা জীবন জীবিকা ও লেখাপড়ার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে বিশ্বময় । উদার ও মানবিক সংস্কৃতির বাহক হিসাবে শুধু বাঙালী নয় বাঙালীর কৃষ্টি ,ভাষা ও সাহিত্য মুল্যায়িত হচ্ছে আজ সর্বত্র ।
অষ্টাদশ শতকে বাঙালীদের আগমন ঘটে ব্রিটেনে। ব্যাপকতা পায় গত শতাব্দীর মধ্যভাগে। সত্তরের দশকের পর থেকেই বাংলা ও বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। গত কয়েক দশকে কিছু সংখ্যক শিল্প ও সাহিত্যানুরাগীদের প্রচেষ্টায় ব্রিটেনের সাংস্কৃতাঙ্গন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে এখন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা থেকে একে কোন অংশেই খাটো করে দেখা সম্ভব নয়।
যাদের প্রচেষ্টায় ও শ্রম কষ্টে আমাদের এই অর্জন তাঁদের মধ্যে সদ্য প্রয়াত কবি নজরুল ইসলাম নাজ একজন।
বাংলাদেশের সিলেট জেলাধীন গোলাপগঞ্জ থানার চন্দরপুর গ্রামে সত্তরের দশকে তাঁর জন্ম। সুরমা ,কুশিয়ারার বহমানতার সাথে বেড়ে উঠা। সোনালী ধান আর সুন্দর ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছাকাছি থেকে যখন কবির কৈশোরত্ব কাটছিলো ঠিক তখনি বিলেতে ফাঁড়ি জমান তিনি।
বিলেতে এসে লেখাপড়া ,বেড়ে উঠা ও ইংরেজী সাহিত্য চর্চা এর কোনটিই বাংলাদেশ ,বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমাতে পারেনি।
চলনে অত্যন্ত সাদাসিদা এই মানুষটি লন্ডনের প্ৰাচীন সাহিত্য সংগঠন 'সংহতির 'সাথে অতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন। বার্মিংহাম সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত 'সাহিত্য উৎসব সমূহেও নিয়মিত উপস্থিত হতেন তিনি। যেকোন অনুষ্টান হোক পিছনের কোন এক কর্নার নতুবা নিরিবিলি একটু জায়গা সেটিই ছিল তাঁর বসার স্থান। দেখে মনে হতো ,পিছনে থেকে তিনি যেন সকলকে সম্মুখে এগিয়ে দিচ্ছেন।
কবিতা লেখার চেয়ে কবিতার অনুবাদে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী ভাষাতেও কবিতা লেখার দক্ষতা তাঁর কোন অংশে কম ছিল না। ব্রিটেনের ভিন্ন ভাষার কবিদের সাথেও ছিল তাঁর দারুন সখ্যতা।
বিলেতের বাংলাভাষী কবিদের কবিতা ইংরেজী অনুবাদের মাধ্যমে ভিন্ন ভাষীদের নিকট পৌঁছে দেবার তিনি স্বপ্ন দেখতেন। বাঙালী কবিদের দ্বারে দ্বারে যেতেন। অনুবাদের জন্য বই দেবার অনুরোধ করতেন।
তিনি মাইকেল মধুসূদন হতে চাননি তবে বিলেতের বাঙালী কবিদের মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমপর্যায় ভুক্ত হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন সচেষ্ট।
তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে কবিতা নিয়েই কাজ করতেন। কবিতার স্ট্রাকচার ছাড়াও ভাবগত বিষয়কে আরও গভীর ভাবে আত্মস্থ করার জন্য সর্বোপরি একটি ভাষাভাষি মানুষের মনোজগতকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে তিনি বার বার বাংলাদেশে যেতেন।
লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আলাদা আরেকটি টান ছিল। লালন ও আব্দুল করিমের গানের অসম্ভব রকমের ভক্ত ছিলেন তিনি। কখনও ছোটে চলতেন কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় আবার কখনও দেখা যেত তাঁকে বাড়ীর নিকটে বাউল সম্রাট করিমের আস্থানায় । সাঁইজীর ভাব ও ধ্যান ধারণাকে নিজের মধ্যে লালন করতেন কবি ।
দেশকে ভালোবাসতেন। হাওর ,নদী নালা অধ্যুষিত জন্মভূমি সিলেট তাঁর অন্তরে যেমনি জ্বলে উঠতো ঠিক তেমনি কবিতায়ও ফুঠে উঠতো অনবদ্য হয়ে।
'হাতকরা ইরম' কবিতায় কবি সুস্পষ্ট ভাবে তাঁর অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মৃত্যু পূর্ব সময়ে তাঁর সতীর্থ কবি মুজিব ইরমকে নিয়ে লিখা এই কবিতাটিতে কবি বলছেন -হাতকরা যেমন আমার খাদ্যে /মুজিব ইরমের কবিতা তেমন পদ্যে /ধন্য আমি সিলেটের মাটিতে জন্মে /হাতকরা -মুজিব বুঝতে পারি মর্মে মর্মে ---
তাঁর কবিতায় দার্শনিকতার ছাপ পাওয়া যায়। তুষারে আগ্নেয়গিরি কবিতায় কবি লিখেন যত সব ঝলকায় তত সব সোনা নয় /সুন্দরী গোলাপের গায়ে শুধু কাটা রয়।
অসুস্থ অবস্থায় একবার লিখেন Poet/not well/in body/and in mind/words are injured/ orphaned today . অর্থাৎ কবির /মনও ভালো না /শরীরও ভালো না /শব্দরা আজ আহত এতিম।
বিলেতের বাঙালী পাড়া আর বাংলাদেশ দুটোতেই তাঁর ছিল সমান বিচরণ । কথা নেই বার্তা নেই চলে যেতেন দেশে । দেশের প্রকৃতি আর মানুষ তাঁকে টানত চুম্বকের মত ।
অতি সাধারণের মত চলতেন তিনি । হাতে কবিতার বই আর পকেটে কলম এই দুটোই সম্পদ ছিল কবি নজরুল ইসলাম নাজের ।
২৯ মে ২০১৬ সিলেট থেকে চন্দর পুর গ্রামের বাড়ীতে আসছেন কবি । পিছন থেকে ঘাতক ট্রাক তাঁকে বহনকারী ফোর স্ট্রোক কে ধাক্কা দেয় । ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন । তাঁর মৃত হাত আঁকড়ে ধরে কবিতার বই ,বুক পকেটে তখনও কলম । শরীর আঁকড়ে ধরে ভালোবাসার স্বদেশ । তিনি যে স্বদেশ ও স্বজাতিকে বড় বেশী ভালোবাসতেন । উৎসর্গকৃত হলো শেষ নিঃশ্বাস স্বভূমিতে। ভালোবাসার দেশ ও মানুষের সান্নিধ্যেই মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সমাহিত হলেন আমাদের একান্ত আপনজন কবি নজরুল ইসলাম নাজ।