“চিরতরে দূরে চলে যাবো”- বলা মানে,
চিরতরে সব ছেড়ে চলে যাওয়া নয়!
বারবার ঝড়ো হাওয়া হয়ে ফিরে আসা;
ঝরণার বুকে ফেরে খরস্রোতা নদী,
ফিরে আসে সব গান-কবিতা ধ্রুপদী॥


হতাশাও অবশেষে খুঁজে পায় কূল,
সবশেষে আলো পাই ভেঙে গেলে ভুল;
যেমন সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফেরে সব পাখিকুল,
তেমনই তুমি ফিরে এলে নজরুল॥


ফিরে এলে চেনা সেই রাগিনীর সুরে,
ঝঙ্কারে ডঙ্কারে এ হৃদয় জুড়ে;
বাঁধো কি বীনার-বাণী ব্যথা ভরা মনে?
ভালোবাসা আলো খোঁজে নয়নের কোণে॥


জাগ্রত আজো তাই পদ্মার ঢেউ,
নারগিস হয়ে ফিরে এলো বুঝি কেউ!
মনের রাজ্যে আছে যতটুকু ধন,
প্রিয় মন দেয় সবি, মন নিয়ে মন॥


ফুলে-ফলে-ঘাসে রঙিন পাখনা মেলে,
এই বুঝি কবি হৃদয় কুঁঞ্জে এলে॥
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে আবার ছুটেছো কোথা?
তুমি দুরন্ত! তুমি ঈপ্সিত প্রথা!


ভেঙে-চূড়ে গড়ো ইস্পাত বাহুবলে,
অগ্নিরে তুমি পুড়িয়েছো দাবানলে।
বজ্র-আঁটুনি, বেঁধেছিলে ভয়-ভীতি,
যমদূতেরেও শেখালে সান্ধ্যনীতি॥


চেয়ে দেখো কবি, তোমার প্রাণের মেঘনা-যমুনা নদী,
ধারণ করে বুকে তোমারে বয়ে যায় নিরবধি।
শ্যামল দু’কূল সাজিয়েছে, শুধু তোমায় দেখাবে বলে,
বাবরি-দুলিয়ে বাঁশরী বাজিয়ে, কবে যাবে তুমি চলে?


হে কবি, নন্দিত-বিদ্রোহী-জ্ঞানী,
দেখো দেখো ফিরে আয়নায় মুখখানি।
আমার জলেরা চলে এঁকে-বেঁকে,
দোঁয়াশ-পলির কাদা গায়ে মেখে;
কবি ও কবিতা মিলে মিশে আঁকে,
নজরুল ছবি হৃদয়ের বাঁকে।


সেই নজরুল আকাশের ফুল-
মেঘ হয়ে হাসে ঘন কালো চুল,
ঝাঁকড়ানো তালে বাবরির দোলা-
কাঁধে জাদুকরী কবিতার ঝোলা,
সোনার নায়ের মাঝি কি’বা আজ-
পক্ষীরাজের পিঠে মহারাজ,
নতুবা রথের মহারথী বেশে-
অট্টহাসির কাঁপুনিতে হেসে,
শূন্যে যখনি হঠাৎ বিলীন-
মুখখানি নীল আলোয় মলিন।


“কবি বলে হায়, কে আছে সহায়!
কোন আলো পারে প্রেমের আভায়?
রাঙাতে আঁধার ঝিঁঝিরা ডাকার-
তৈল-তৃষিত জীবন চাকার॥
সাদা ফেস্টুন হাতে বলে তাই,
মানবতাময় মানবতা চাই।
আহারে আমার বুক থেকে আর
নিওনাকো কেড়ে শ্রমিক যুবার,
ওদের শ্রমের ঘামের স্রোতেই
সভ্যতা আসে তাদের ব্রতেই।


হাতে হাত রাখি এসো সবে আজ,
মানিনাকো ভূত-রাজা-মহারাজ;
অশুচি ও যত কিম্ভূত দূত,
দূরীভূত হোক নিয়মের খুঁত।


মায়া-মমতায় কাছে টেনে নিয়ে-
আদরে সোহাগে ভালোবাসা দিয়ে,
কিভাবে? কি করে? ব্যাঞ্জনাময়,
স্বজন হারার শোক করি জয়!


কি করে? আঁধারে হাল ধরে ধরে,
সোনার নৌকো টেনে নিই তীরে?
তাইতো কবির কবিতার বাণী,
সবুজ আলোর মৃদু হাতছানি।


সবুজ শ্যামল হয়ে জাগে প্রাণ,
বেঁচে থাকা হয় সুরেলা আযান।
জীবনের দামে যারা দেয় দান,
শ্রদ্ধাঞ্জলি তার প্রতিদান॥”


এই বলে কবি উদাস নয়নে,
মিশে গেলো দূর আকাশের কোণে।
হৃদয় জানালা তবু রাখি খুলে-
আবার কবে যে বাবরির চুলে,
কোহেকাফ ছেড়ে হুরপরি ভুলে-
ফিরে আসে মেঘে রঙধনু তুলে॥


তারপর।
হাজার বছর, অর্বুদবর্ষ;
নিমিষেই হয়ে যায় শেষ,
গতি-রাশি ফিরে আসে মুহূর্তের প্লাবনে,
শনশন বায়ু-বেগ, মহাকাল ফিরে আসে,
মেঘদূত হয়ে ফেরে রমণীর এলোমেলো কেশ;
তবু যার রয়ে যায় বানী ও সুরের সেই-
মধুমাখা অলীক এক রেশ॥


নীরব আজ মহাকবি-
ছুটে আসে ইন্দ্র-ধনুকে চড়ে টগবগে ছবি।
তীরের ফলার মতো চকিত আগমনে,
কিঞ্চিৎ ব্যবধানে সমান্তরালে হাসে!
জোছনায় ঢাকা চাঁদ; তারপরে ঝলমলে রবি॥