বাবা প্রচণ্ড বই পড়া মানুষ। সময় সুযোগ পেলেই বই হাতে নিয়ে বসে যায়। ধর্মীয় বইগুলো বাবা বেশি পড়ে। মাঝে মাঝে শব্দ করে সুর করে করে পড়ে। যেন আমরাও শুনি। মাঝে মাঝে আমিও পড়তাম বাবার বইগুলো। মা ফাতেমার জীবনী, কারবালার ময়দান, শেষ নবী মোহাম্মাদ (সঃ)। কচি হৃদয়। বাবার এই সব বই পড়ে খুব আবেগ আল্পুত হয়ে যেতাম। বিষাদ সিন্ধু বইটা ছিল খুব মোটা। প্রচ্ছদে বহু তীরবিদ্ধ একটা ঘোড়ার ছবি আঁকা। লাগাম ধরে আছেন একজন আলখেল্লা পরা লম্বা মানুষ। প্রচ্ছদ দেখেই পড়ার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু কাজ হবে কি? কিছুই বুঝতাম না। আমার ব্যাকুলতা বাবা একদিন খেয়াল করে আমায় বুঝিয়ে বললেন সেনাপতি এজিদ আর হাসান হোসেনের গল্প। জায়েদার বিষপানের কথা বাবা অবশ্য সেদিন বলেননি। যাইহোক, সেই থেকে বই পড়া শখ।


এরপর আমারও বই কিনতে মন চায়। তখন হয়তো সপ্তম শ্রেণিতে। বড় আপা আমাকে নিয়ে গেলেন ব্যাংকে। টাকা তোলা শেষে আপাকে জোর করে নিয়ে গেলাম একটা বইয়ের দোকানের সামনে। তখন জুন মাস। আপা বলছিল-
-তোর তো বই কেনা শেষ।
-একটা গল্পের বই কিনবো
-ধ্যাত, এমনি বই পড়েনা সারাদিন টন টন করে ঘুরে বেড়ানো। আবার গল্পের বই!
দোকানদার আমার পক্ষ হয়ে একটু বলল 'আপা ছোট মানুষ, বড় আশা করে এসেছে । দিন না একটা কিনে। আপা হয়তো শরমে পড়ে একটা কিনে দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আমি আর দোকানদার আপাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ১০০ টাকায় তিনটা বই কিনেছিলাম। গোপাল ভারের গল্প, ছোটদের হাঁসির গল্প, সুকুমার রায়ের 'খাই খাই' কবিতার বই। দুই দিন সময় লাগলো তিনটা বই পড়তে। তারপর??


সিনেমার গল্পের মতো টিফিনের টাকা বাঁচানো শুরু। শুধু কি আর টিফিনের টাকা? মা'র তোষকের নিচের খুচরা টাকা, বাজার থেকে ফিরলে বাবার পকেট হাতানো, বড় আপার ব্যানিটি ব্যাগ সব ব্যয় করতাম নেশায়। বই পড়ার নেশায়। এ নেশায় বাবা কিছুটা সায় দিলেও মা একদম তেলে বেগুনে। বড় আপা তেমন কিছু বলতনা। শুধু ওর টাকা চুরি করলেই মুশকিল।


ক্রমশ বয়স বাড়ছে। আমি পরিবর্তন হচ্ছি পরিবর্তিত হচ্ছে আমার বইয়ের ধরণ। গোপালভার এখন আর কিনছি না। এখন কিনছি কাজী নজরুল, সুকান্ত, জসীম উদ্দিন। তখন দশম শ্রেণিতে। তখনই পড়ে ফেলেছি 'নৌকা ডুবি, চোখের বালি, দত্তা, দেবদাস, নকশী কাঁথার মাঠ, তারাশংকরের কবি, মেক্সিম গোর্কীর মা, তিতাস একটি নদীর নাম এছাড়াও অনেক বিখ্যাত উপন্যাস। রাত ভোর হয়, ভোর হয় সন্ধ্যা। আমি বইয়ের সাথেই।


সেবার রাত তিনটা বাজে। ভাইজান (বড় ভাই) ঘুম ভেঙে দেখে আমি পড়ছি। তাঁর ঘুমু ঘুমু চোখে একটা খুশির ছাপ। হয়তো ভাবছে ভাইটা একদিন পড়াশুনা করে অনেক বড় মানুষ হবে। কিন্তু কাছে আসতেই তাঁর চোখ উঠে গেলো কপালে। কড়কড়ে চোখে একবার তাকাল আমার দিকে। তারপর আর কিছু বললনা। হয়তো এজন্যই বলেনি কারণ পরেরদিন সকালে আমার পরীক্ষা।


একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি আমার একটা লেখার ডায়রি আর বেশ কিছু বই আগুনে জ্বলছে। আগুনে কি আর বইয়ের অক্ষর জ্বলছে? জ্বলছে আমার কিশোর বয়সের আবেগি হৃদয়। কষ্টে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিঃশব্দ কান্না। শুরু হল অনশন। বাবা ভাইজানকে খুব বকেছিল কাজটা সে অন্যায় করেছে। কিন্তু ছোট ভাই রাতভর শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের বানী পড়ছে টেক্সট বই পড়া বাদ দিয়ে সেটা দেখে কার বা মাথা ঠিক থাকে। তারউপরে কত পুঞ্জিবিত আশা ভরসা।


২০০৮ সালের কথা। ভাইজান বিদেশ যাবে। আমি বাস স্টেশন পর্যন্ত বিদায় জানাতে গেলাম। ফিরে আসার সময় ভাইজান আমাকে একশো টাকার তিনটা নোট বের করে দিলো। বলল রিক্সায় বাড়ি যাবি আর বাজার থেকে কিছু কিনে খাস। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্য। ত্রিশ টাকা পকেটে রেখে বাকি টাকায় পাঁচটা বই কিনে বাড়ি ফিরলাম। বনফুল রচনাবলী, সঞ্চিতা, গৃহদাহ আরও দুইটা বই। সেই থেকে শুরু......... এখন আমার একটা নিজস্ব লাইব্রেরী । সব রকমের বই-ই আছে।