বাংলার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই।সংস্কৃত থেকে বাংলা বর্ণমালার রূপ গৃহীত,অবশ্য রূপের বহিরঙ্গে নয়- উচ্চারণের অন্তরঙ্গ দিকে।কাজেই বানানের পার্থক্যগুলি একান্তভাবে স্মৃতি নির্ভর।তাই বানান ভুল হওয়া স্বাভাবিক।


বাংলা একটি মিশ্র ভাষা।এত তৎসম,অর্ধতৎসম,তদ্ভব,দেশী,বিদেশ প্রভৃতি নানা প্রকার শব্দের সমাবেশ ঘটেছে।মিশ্র ভাষার ধ্বনিরূপ সর্বদা অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল।স্থিতিশীল বর্ণমালার দ্বারা পরিবর্তনশীল উচ্চারণকে সুষ্ঠভাবে প্রকাশ করা যায় না।মোদ্দা কথা হল,বাংলা বর্ণমালায় সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা এমন অনেক শব্দ আজকাল ব্যবহার করছি,যার ধ্বনিরূপ আমাদের বাংলা বর্ণমালায় নেই,অনেক উচ্চারণ আছে যার বর্ণ নেই।তাই সমস্যা জটিল হয়েছে।এই সমস্যা সমাধানের জন্য পঃবঃ বাংলা আ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে কিছু বানান বিধি নির্দিষ্ট করা হয়েছে।বাংলা  বানানের ক্ষেত্রে সমস্যা মোটামুটি তিন ধরণের-
১. বর্ণমালার সমস্যা
২.ভাষার সমস্যা
৩. উচ্চারণ সমস্যা


আজ আমরা " বর্ণমালার সমস্যা" নিয়ে আলোচনা করবো।


বাংলা শব্দ ভান্ডার দুটি ভাগে বিভক্ত- ১) তৎসম ও ২) অর্ধ তৎসম।তৎসম শব্দগুলি অবিকৃত শব্দ,সুসংহত ব্যাকরণ দ্বারা সেগুলি নিয়ন্ত্রিত।বাংলা বর্ণমালা ও সংস্কৃত বর্ণমালা উচ্চারণগত দিক থেকে পৃথক।কারণ বাঙালীর জিহ্বায় শ,ষ,স,ব,ন,ণ,ই,ঈ,উ,ঊ-এদের উচ্চারণের কোন ভিন্নতা নেই।অথচ এগুলি সংস্কৃত ব্যাকরণ সূত্র অনুযায়ী শব্দের মধ্যে ব্যবহৃত হয়।সেজন্য বানান ভুলের সমস্যাটা গুরুতর আকার নিয়েছে।


এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলা অ্যাকাডেমি কিছু বিধিমালা তৈরী করেছে।বাংলা বর্ণমালার সংস্কার সাধনে কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কোথায় কিভাবে বানান বা বর্ণের ব্যবহার হবে তা জানতে হলে নিম্নের আলোচনাটি আমাদের ধৈর্য ধরে পড়তে হবে-


১) ই,ঈ,উ,ঊ সম্পর্কেঃ- তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে  'ই',উ,ঈ,ঊ হবে।তদ্ভব বা অর্ধ তৎসম শব্দে 'ঈ' 'ঊ' বা বিকল্পে 'ই','উ' ব্যাবহৃত হবে।যেমন- পক্ষী,পাখী,কুম্ভীর,কুমীর।তবে হ্রস্ব বিকল্প না থাকলেও তৎসম শব্দের বানানে দীর্ঘ স্বর চিহ্ন'ই লিখতে হবে।


২) সংস্কৃত ইন্। প্রত্যয় যুক্ত শব্দের ক্ষেত্রে সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যাপারে সংস্কৃত মূল শব্দটির দীর্ঘ 'ঈ' কারের পরিবর্তন করা যাবে না।যেমন-আগামীকাল,মন্ত্রীসভা,হস্তীদল ইত্যাদি।কিন্তু তৎসম "ত্ব" এবং "তা" প্রত্যয় যোগ করলে যে শব্দ পাওয়া যাবে সেগুলির ক্ষেত্রে হ্রস্ব 'ই'-কার রূপে লেখা হবে।যেমন- প্রতিযোগিতা,মন্ত্রিত্ব,সহমর্মিতা,লিঙ্গান্তরে "নী" প্রত্যয় যোগের আগে এই নিয়ম পালিত হবে।যেমন-প্রতিদ্বন্বিতা,প্রতিযোগিনী।


৩) বিসর্গ( ঃ ) সম্পর্কেঃ সংস্কৃত শব্দের অন্তে থাকলে তা বর্জিত হবে।যেমন-যশ,মন,বক্ষ।কিন্তু শব্দের মধ্যে থাকলে বিসর্গ বজায় থাকবে এবং বিসর্গ সন্ধি অনুসারে বানান নির্ধারিত হবে।যেমন-মনঃ+যোগ=মনোযোগ,যশঃ+লাভ=যশোলাভ।ব্যাকরণ সম্মত কোন বিকল্প রূপ থাকলে সেগুলিও ব্যবহৃত হবে।যেমন-দুঃস্থ>দুস্থ,বয়ঃস্থ>বয়স্থ।


৪) হসন্ত চিহ্ন সম্পর্কেঃ- শব্দের অন্তে 'হস্' চিহ্ন বর্জনীয়।যেমন- ক্রোধ,গর্জন,সাবাস,সবুজ ইত্যাদি।তবে সংস্কৃত সন্ধিজাত শব্দে পূর্ব পদের শেষে হস্ চিহ্ন থাকবে।যেমন-দিক্ ভ্রান্ত,উদ্ ভ্রান্ত,পৃথক্ করণ(হসন্ত দিয়ে একসাথে লেখা যাচ্ছে না)


৫) রেফ সম্পর্কেঃ-সংস্কৃত শব্দে রেফ যুক্ত ব্যঞ্জন বর্ণের দ্বিত্ব সর্বত্র বর্জনীয়-ধর্ম,কর্ম,মূর্খ আবার অসংস্কৃত শব্দেও রেফের পর দ্বিত্ব হবে না।যেমনঃ সর্দার,কর্ম,পর্দা,সর্ব ইত্যাদি।


৬) ঙ এবং অনুস্বর সম্পর্কেঃ ক,খ,গ,ঘ,ঙ পরে থাকলে সংস্কৃত শব্দে বিকল্প 'ম' স্থানে 'ং' হবে।যেমন- অহংকার,সংখ্যা,সংঘ।যে সব শব্দে সন্ধি পরিণাম হিসাবে অনুস্বর আসে নি সেখানে 'ং' অবৈধ।যেমন- বঙ্গ,অঙ্ক,আতঙ্ক,শঙ্কা,সঙ্গে ইত্যাদি।
আবার ম-এর পরবর্গীয় "ব" থাকলে তা"ম"ই হবে।যেমন-সম+বোধন=সম্বোধন, অবলম্বন ইত্যাদি।আবার ম-এর পর অন্তঃস্থ ব থাকলে ম বর্ণটি অনুস্বর হবে।যেমন-কিংবদন্তি,কিংবা,সংবাদ ইত্যাদি।আবার কোন কোন হেত্রে ঙ্গ ও ঙ দুই-ই চলে।যেমন- বাঙ্গালী>বাঙালী;ভাঙ্গন>ভাঙন ইত্যাদি।তবে হসন্ত ধ্বনি থাকলে অনুস্বরও বসতে পারে।যেমন-বাংলা।


৭)কিছু বিশেষ্য শব্দে য-ফলা হবে।যেমন-চারিত্র্য,দারিদ্র্য ইত্যাদি।বিশেষ ক্ষেত্রে ব-ফলা ভেঙে লেখা হয়।যেমন-উদ্.বাস্তু;উদ্.বোধন ইত্যাদি।যেখানে আলাদা উচ্চারণ হয় না সেখানে উদ্যান,বিদ্বান,উদ্যম ইত্যাদি লেখা উচিত।


৮) শ,ষ,স সম্পর্কেঃ সংস্কৃত শব্দ অনুযায়ী তদ্ভব ও অর্ধ তৎসম শব্দে "শ"-ই ব্যবহৃত হবে।যেমন-বাঁশ,মশা,কোশ,কিশলয়,শিশু ইত্যাদি।আবার কিছু ব্যতিক্রমও আছে।যেমন-মনুষ্য>মিনসে,শ্রদ্ধা>সাধ।বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুযায়ী "S" বা "Sh" স্থানে শ বা ষ হবে।যেমন- শহর,ইস্কুল,পোশাক,আসল ইত্যাদি।


৯) ন,ণ সম্পর্কেঃ-অসংস্কৃত সমস্ত শব্দে ন হবে;যেমন-কান,সোনা,বামুন,রানী ইত্যাদি।অর্ধ তৎসম শব্দের মূর্ধন্য বর্গের বর্ণের সঙ্গে যুক্ত "ণ"-র ক্ষেত্রে"ন" গ্রাহ্য হবে।যেমন- প্যান্ট,লন্ঠন;কিন্তু তৎসমজাত অর্ধ তৎসমতে "ণ" হবে।যেমন-আণ্ডা,কুণ্ডু,মুণ্ডু ইত্যাদি হবে।


১০) জ,য সম্পর্কেঃ নিম্নে বর্ণিত শব্দে য-এর বদলে জ ব্যবহার বাঞ্ছনীয়।যেমন-কাজ,জুঁই,জাতি,জুত,জো,জোড়,জ্যোতি ইত্যাদি।
===========================
*** পাঠকের আগ্রহ লক্ষ্য করলে,পরবর্তী কিস্তি প্রকাশের ইচ্ছে থাকলো।
*তথ্যসূত্রঃ পঃবঃ বাংলা বানান বিধি গ্রন্থ,উইকিপেডিয়া,ডি.এল.এড বাংলা