। বিভূতিভূষণ।


বাবা যেদিন রাতের তারা চেনালেন ছাদে উঠে,সেদিনই আমার সর্বনাশ ঘটলো।
ভূগোলের জ্ঞান আর কালপুরুষ , লুব্ধক , সপ্তর্ষি, দুয়ে মিলে কল্পনার ঘোড়া ছুটলো,
আমার দুর্গাপুরের সরকারী কলোনির কোয়ার্টারের পাঁচিল ডিঙিয়ে,
স্টেশন অবধি চলে যাওয়া বিজলির তারে বসা পাখিগুলোকে চমকে দিয়ে,
বটগাছের পাহারায় থাকা বড়মাঠটার থেকে আমার বিমান উড়ে যায়,
সোজা আফ্রিকায় নামবে বলে। সেখানে দিনে সূর্য ঢুকতে লজ্জা পায়,
আমি খুঁজি বাওবাব গাছের মধ্যে কোথায় একফালি চিলতে আকাশ,
দিনে সূর্যের গতিপথ আর রাতে চিনে যাওয়া লুব্ধক ইত্যাদি আমার কম্পাস,
সঙ্গে গোপন ম্যাপ, নরখাদক অধ্যুষিত উপত্যকা, পদে পদে মৃত্যুর ফাঁদ,
লাঠি হতো বন্দুক, থাম বাওবাব গাছ, আফ্রিকা হয়ে যেতো দুই কাঠা ছাদ।
স্যান্ডো গেঞ্জি আর ঢলঢলে হাফপেন্টুল পরা ছেলেটা আসলে কে?
লুকিয়ে লুকিয়ে সে পাঁচিলের এককোণে গোটা গোটা অক্ষরে 'শঙ্কর' লেখে।


ষোলোর কিশোর এসেছি কলকাতায়, জ্যাম আর মিছিলের চেনা পরিবেশে,
শোনা গেলো, মাটি ফুঁড়ে রেল চলে ভবানীপুর থেকে, প্রখম এ দেশে।
চটি পায়ে গুটি গুটি ,একদিন টুক করে বাসে চড়া গেলো পেয়ে ছুটি
পকেটে ঝনঝনি খুচরো রয়েছে, সব মিলে ধরা যাক কুড়ি টাকা হবে মোটামুটি।
ধুলোমাখা রাস্তার থেকে পাতালের সিঁড়ি নেমে তকতকে স্বপ্নের পুরী
প্রথম বিশ্ব থেকে কোনো ভোজবাজিতে গোটা স্টেশন এক হয়ে গেছে চুরি।
একটু দাঁড়িয়ে দেখি ঘোষণার সাথে সাথে সুড়ঙ্গ আলো করে ভোঁ সাইরেন,
কোথায় স্টেশন গেলো, চারদিকে কাশবন, ছুটে ছুটে এক 'অপু'
ওই দেখে ট্রেন...


আরো কিছু বড় আমি, টানটান যৌবন, সবে পড়াশোনা হলো শেষ,
ইট কাঠ বালি থেকে কয়দিন ছুটি নিয়ে ভাবি যাই জন্মের দেশ।
যদিও সবাই বলে কারখানা নগরী, তবুও গাছেরা সেখানে বড় প্রিয়,
শাল শিমুলের মাঝে কৃষ্ণ ও রাধাচূড়া, কখনো সময় পেলে আমার শহর ঘুরে যেও।
জন্মের থেকে দেখা ঘরের সামনে এক মস্ত রাধাচূড়া  গাছ আছে,
বস্তুত দূর থেকে গাছটা দেখতে পেলে বুঝে যাই ঘর এলো কাছে।
এবারে কি যে হলো, বাড়ি কাছে এসে গেছে, অথচ সে গাছ কই গেলো?
বাড়ি ঢুকে শুনলাম, রাস্তা চওড়া হবে, সেই হেতু গাছ বলি হলো।
দুচোখ ঝাপসে এলো, এটাই নিয়তি আজ, উন্নতি অজুহাতে গাছের মরণ,
বুকের ভেতরে ওঠে হাহাকার কান্নার, অরণ্য শেষ হলে শোকার্ত হয় আজও সত্যচরণ।


এখন বয়েস এসে রোজ যায় কড়া নেড়ে , চোখে ভারী চশমা উঠেছে,
সময়ের দাবী মেনে ইন্টারনেট শিখি, বেশ কিছু বন্ধু জুটেছে।
এদের সাথেই নানা আলোচনা করে যাই , সক্কলে একই কথা বলে,
ভালো নেই কেউ আজ, অসুর রেখেছে আজ যাবতীয় ভাবনা দখলে।
উন্নয়নের মানে জনতার ভাগে ঢু ঢু, প্রাকনির্বাচনে বলা কোনোদিনও না হওয়া স্বপ্নসড়ক,
দেশ কি এগোতে পারে, চারদিকে লাগে যদি জাতপাতধর্মের ভাবনামড়ক?
রোজ আরো ঘিলু খেয়ে ফুলেফেঁপে বেড়ে ওঠে সুবিধার রাজনীতি , ধর্মদূষণ,
এ আকালে এবারে কি গঙ্গাচরণ হতে আমাকে দেবেন ডাক বিভূতিভূষণ?


আর্যতীর্থ