। বিকেলের প্রতিবেদন।


আশ্রম বোলো না, ওতে বড্ড সন্ন্যাসের গন্ধ।
আবাস বোলো না, আমাদের কারোর বাড়ি এটা না।
জীবনের সন্ধ্যায় এসে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখানে উঠেছি,
অসহায় বলে নই,
কিছুটা সহায়সম্বল আছে বলেই।
নইলে ফেলে আসা বাড়ির এককোণে বাতিল আসবাবের মতো পড়ে থাকা,
নয়তো স্মৃতির গোলকধাঁধায়
কোনো রাস্তায় বা স্টেশনে বসে আকুল ডাকা
‘ আমায় ঘরে নিয়ে যাবি না রে?’
যাকে ডাকা, তার জানা কোথায় ছেড়ে দিয়ে গেছে বাবা অথবা মা’কে,
যতটা পারে , যেমন করে পারে,
সেই জায়গা থেকে সে দূরে থাকে।


আমাদের ভাগ্য অতটা খারাপ নয় ।
ব্যাঙ্কে কিঞ্চিৎ লক্ষ্মী না থাকলে সায়াহ্নে অন্নসংস্থান পরমুখাপেক্ষী,
আপণের ঝাঁপ ফেলে দিলে আপন আর পায়ে ঝাঁপ দেয় না,
সঞ্চিত ধনই বার্ধক্যের রক্ষী,
এই আপ্তবাক্য ভুলে গেছে যারা যৌবনে,
সূর্য পশ্চিমে গেলে অভাবের ছায়া পড়ে তাদের উঠোনে,
বিকেলবেলায় নামে রাতের আঁধার,
বুড়ো হওয়া সৌভাগ্য না দুর্ভোগ হবে,
যুবাকাল করে ফেলে নির্মাণ তার।


কখনো ভেবেছো,
বাড়িতে দুমুঠো দিয়ে এককোণে ফেলে রাখা
কত বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার নিয়ত নিয়তি?
আমরা ভালোই আছি সেই তুলনায়,
বিকেলে বারান্দা থেকে দেখি,
সামনেই রাস্তায় যুগ বয়ে চলে যায় অস্থিরমতি,
রোজ নাগরিক জীবনে সমস্যা বেড়ে চলে,
টের পাই সাঁঝে টিভি দেখে,
বিশ্বাস করো, এই বুড়ো মানুষেরা প্রায়শই বলাবলি করি, বেঁচে গেছি আজ দূরে থেকে।


তোমরা ভেবেই নাও সন্ততি চায় না আমাদের,
মনে মনে এঁকে নাও রুষ্ট পুত্রবধূ ,
বেজার মুখ পুত্র ,
শ্বশুরবাড়িতে থিতু হয়ে হাত উল্টে বলা আত্মজা
‘ আমার পক্ষে সম্ভব না খেয়াল রাখা এত দূর থেকে!’
সারসংক্ষেপে , ভয়ানক করুণা হয় আমাদের দেখে,
তাই না?
আমি যদি বলি ওরা ডাকে, তবুও আমি থাকতে যাই না,
যদি বলি আমার পাশের ঘরের ভদ্রমহিলার বসতবাড়ি ভাড়া দেওয়া এই শহরেই,
যদি বলি তিনটে ঘর পরে চুরাশি বছরের বুড়োটি এখনো নিয়মিত শেয়ার মার্কেটে লগ্নী করেন,
অবিশ্বাস্য ঠেকবে?


ব্যাপারটা বাস্তব, ভালো করে খোঁজ নিলে দেখবে।
আমাদের বার্ধক্যের একটা সমস্যার কথা তোমরা যৌবনে কখনো বুঝতে পারবে না।
একাকিত্ব।
দৈনিক অন্তহীন একাকিত্ব,
যেখানে ঘড়ির আর কোনো অর্থ থাকে না,
ক্যালেন্ডারের প্রত্যেকটা দিন একই রকম সংলাপহীন।
এই ক্ষুধার্ত সময়ে,
যখন প্রত্যেকটি মানুষ শুধু টিকে থাকার
থাকার জন্য উদয়াস্ত শ্রমে ক্লান্ত,
সেখানে বাতিল বুড়োবুড়িদের এই হাল বদলাবে না কোনোদিন,
আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে
ধারণা বিনিময়ের সঙ্গী,
দুঃখ বাঁটার বন্ধু,
এক সাথে হেসে ওঠা নকল দাঁতের পাটি।
বর্তমানের সাথে আমাদের কিছুই মেলে না,
যুগের হাওয়া
শুধু তোমাদেরই নৌকার পালে,
তার কিছু যাবে আসবে না আমরা হারালে ।


সঙ্গতি আর ক্ষমতা থাকতে থাকতে
তাই আমরা বেরিয়ে এসেছি,
একজোট হয়েছি একেকটি আবাসনে।
কলেজের পরে বন্ধু হয় না,
সেটা যে ভয়ানক মিছেকথা,
এই আয়ুর শেষের ধাপে এসে বুঝেছি।
শুধু তফাৎ এইটুকুই, আমার বন্ধুদেরও এই একই ঠিকানা।


তোমাদের পৃথিবীর আমাদের দুনিয়ায় ঢোকা মানা,
বার্ধক্যে না পৌঁছালে এখানে ঢোকার পথ থাকে অজানা।


আবাস বা আশ্রম নয়,
আমি আর আমার নতুন বন্ধুরা ভালোবেসে
আমাদের আস্তানাটাকে অন্য আরেক নামে  ডাকি,
শুনবে তা কী?


আমরা দিয়েছি নাম বিকেলের ডানা।


আর একটা অনুরোধ। যাই বলে ডাকো , সামনে বৃদ্ধ বসিয়ে দিও না।


আর্যতীর্থ