কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –নয়ঃ ছন্দ না জেনেও আমরা কীভাবে কবিতা লিখি
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান  মহাশয়কে।      
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
৬) কবিতার সংজ্ঞা ও উপকরণ
৭) ছন্দের সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক  
৮) ছন্দ কেন প্রয়োজন
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ৯) ছন্দ না জেনেও আমরা কীভাবে কবিতা লিখি
------------------------------------------------------------------------------
ছন্দ না জেনেও আমরা কীভাবে কবিতা লিখি? এই প্রশ্নের উত্তর আজ দেওয়া যাক। আমরা যদি আসরকবি বা অপর কবিদের জীবনী পাঠ করি, তাহলে সহজেই জানতে পারব বেশিরভাগ কবি স্কুলজীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছেন। অনেকে অনেক ছোটোবেলা থেকে ছড়া পড়তে ও গড়তে পারেন। কিন্তু কীভাবে এই লেখা হয়ে ওঠে ছন্দের বিজ্ঞান না জেনেও। অনেক কবি স্বীকার করেছেন কলেজে পাঠ করার সময় থেকে তাদের কবিতা লেখার শুরু। এমনকি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপিয়েও ফেলেছেন একাধিক কবিতা। অনেকে আবার কবিতার বই। এ সব সম্ভব হয়েছে তাদের কবিতা পাঠের উপর শক্তি রেখেই। অর্থাৎ বারবার কবি পাঠ করেছেন তার কবিতা আর শুনিয়েছেন নিজের কানকে। কখনও অপর কারও কানকে। কান তার কবিতার ছন্দ স্বীকার করেছে। অনেক সময় শুনতে খারাপ লাগায় কবি সহজেই নিজে থেকেই পরিবর্তন করেছেন কবিতার নানা শব্দ-ভাষা-ছন্দ।
ছন্দবিজ্ঞান আবিস্কৃত হবার আগে মানুষ কবিতা ও গান লিখেছে। আমরাও ছোটোবেলায় লিখেছি। কিন্তু সে কীভাবে! সেই চর্যাপদের যুগ থেকে রামায়ণ, মহাভারত; কত শত পাঁচালিগ্রন্থ নিয়মিত লিখে গেছেন কবিকূল। কিন্তু তারা তো ছন্দের ব্যাকরণ জানতেন না। তাহলে তারা কীভাবে লিখে গেছেন এত শত কাব্যগ্রন্থ। সেই সব কবিরা লিখে গেছেন কানের উপর নির্ভর করে। শ্রুতিশক্তির উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে লিখে গেছেন তাদের নানা সম্ভার। আমরাও অল্পবয়সের লেখালেখিতে এই অভ্যাস মেনে চলেছি এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা অন্ত্যমিলকে গুরুত্ব দিয়েছি সবার আগে। ছন্দ বলতে তখন মিলকেই বুঝেছি। 'ছন্দের যাদুকর' এই শব্দের অর্থ বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আর যা যা ঘটে থাকে তা  দেখে নিই।
ক) মনের আবেগ মিশিয়ে কিছু একটা লেখার তাগিদে কবিতা লিখে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রে বারবার উচ্চারণ করে কানকে শোনানো হয়।
খ) 'ছন্দ' বলতে আমরা আগে অন্ত্যমিলকেই বুঝেছি। শেষের শব্দ তাই মিলিয়ে মিলিয়ে লিখে ফেলি। এখানেও সেই কানকেই শোনানো হয়। কান অনুমোদন দিলেই আমরা রেখে দিই। অর্থাৎ ভালো শোনাচ্ছে।
গ) পাঠের আনন্দ আনার জন্য বারবার পাঠ করে কবিতা স্থির করা হয়। কানে উচ্চারণের সমতা আনা হয়।
ঘ) অন্য কোনো খ্যাতিমান কবির কবিতা পাঠ করে ভালো লেগেছে, তাকে অনেক সময় অনুকরণ করা হয়। সেও কানের সাহায্যে।
ঙ) বিদ্যালয় পত্রিকায় ছাপার জন্য বাড়ির বড়ো কেউ লিখে দিয়ে থাকেন। সেই কবিতা বারবার পাঠ করে একটা কবিতার চেহারা দেওয়া হয়। যা প্রথম প্রকাশিত বলে ধরা হয়।
তাই কবিতা পাঠ করতে করতে মনের মধ্যে কবিতার জন্ম নেয়। ছোটোবেলায় শেখা অনেক কবিতায় আজ পর্যন্ত কারও ভুল হয় না। সেরকম কয়েকটি ছড়া ও কবিতা । যেগুলি পাঠ করতে আমরা কানকেই হাতিয়ার করে তুলি।
ক)
প্রচলিত ছড়াঃ
“দোল দোল দুলুনি
রাঙা মাথায় চিরুনি
বর আসবে এখুনি
নিয়ে যাবে তখনি”


খ) আমাদের ছোট নদী / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।“


গ) আদর্শ ছেলে / কুসুমকুমারী দাশ
"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ –এই যার পণ।"


ঘ) আমাদের গ্রাম / বন্দে আলী মিয়া
"আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।"


ঙ) রাখাল ছেলে/ জসীমউদ্‌দীন
"রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?"


এবার আসি প্রচলিত শ্লোগানের কথায়। বিভিন্ন মিছিল শোভাযাত্রা ইত্যাদিতে আমাদের  দেশে শ্লোগান দেবার রেওয়াজ আছে। সেখানেও ছন্দযুক্ত শ্লোগান বেশি বেশি দেওয়া হয়। তার কারণ ছন্দযুক্ত শ্লোগান মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে।
যেমন- "দিন বদলের বইছে হাওয়া/ শিক্ষা আমার প্রথম চাওয়া।"
এখানে এমন ছন্দ না থাকলে এই আবেদনে এমন সাড়া পাওয়া যেত না। তাই পাঠকপ্রিয়তা পেতে ছন্দ স্বাভাবিক ভাবে এসে গেছে। এখানেও সেই কানের প্রসঙ্গ।


অবশ্য ছন্দ সচেতন হবার জন্য প্রথমেই ছন্দের ব্যাকরণ জানতে হবে এমন নয়। ছন্দের এই তাল-লয় বোঝার জন্য নিজের কানকে তাই তৈরি করতে হবে। এই কান তৈরি করার সহজ উপায় হল- প্রচুর সংখ্যায় ছড়া-কবিতা পাঠ করা। প্রতিষ্ঠিত ছড়াকার ও কবিদের ছড়া কবিতা পাঠ করে কানকে ছন্দ উপযোগী করে তোলা যায়। কান বিষয়ে মোটামুটি সচেতন হলেই ছন্দের বিষয়ে প্রবেশ করা উচিত। তার আগে নয়। তারপর জানার প্রয়োজন হয় ছন্দকে। ছন্দের ব্যাকরণ তখন আর না জানলে চলে না। কবিতায় ছন্দের দোলা আপনাআপনি আসেনি। কবিকে রীতিমতো সাধনা করে কবিতায় ছন্দ নির্মাণ করতে হয়। কবিতায় এই নির্মাণকৌশল তাই পেয়েছে বিজ্ঞানের মর্যাদা।
তাই আজ আমরা কানের উপর ভরসা রাখার সাথে সাথে আমরা জানতে চলেছি এই ছন্দের সাথে যুক্ত নানান খুঁটিনাটি বিষয়। এবার আমরা ধীরে ধীরে সেই সব খুঁটিনাটি বিষয়ের সাথে পরিচিত হব। ছন্দ বিষয়ে আমরা আরও সমৃদ্ধ হব।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) ছন্দের সহজপাঠ- সুজন বড়ুয়া, কথাপ্রকাশ,ঢাকা
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ বিভিন্ন ছড়া ও কবিতা পাঠ করি আর লিখে ফেলি মনের আনন্দে, আজ কানকেই অনুসরণ করে।
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। আসুন এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গঠনমূলক মন্তব্য করি।