‘স্বপ্ন’ শব্দটিকে আমরা, প্রায়শই, ‘বাস্তব’-এর বিপরীত অর্থে ব্যবহার করে থাকি। যদি কোনো মানুষকে আমরা স্বপ্নচারী বলি, তাহলে তার অস্যার্থ দাঁড়ায় যে, সে ঠিক ততখানি বাস্তবমুখী নয়। অথবা, কেউ দিবাস্বপ্ন দেখছে মানেই, বাস্তবজগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ অতিশয় ক্ষীণ। অথচ, স্বপ্ন আর বাস্তব কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, রীতিমতো হাত-ধরাধরি করে চলে। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, অনুভূতিগুলিই, অত্যন্ত ঘনসংবদ্ধভাবে, ফিরে-ফিরে আসে আমাদের স্বপ্নের ভেতর।
আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান অনুযায়ী, ঘুমন্ত অবস্থাতেও, মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া থেমে থাকে না, স্নায়ুগুলি তখনও নিজেদের মধ্যে অবিরাম সংকেত-বিনিময়ের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। আর এই সংকেতগুলি, অ্যামিগডালা, হিপোক্যাম্পাস, ভিশুয়াল কর্টেক্স-সহ মানুষের মস্তিষ্কের সেই অংশগুলিকেই উদ্দীপ্ত করে, যা, জাগ্রত অবস্থায়, বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংবেদনের বিশ্লেষণের জন্য দায়ী। উদ্দীপ্ত হওয়ামাত্রই, তারা মস্তিষ্কে জমে-থাকা স্মৃতির সঙ্গে এই আভ্যন্তরীণ সংবেদনগুলিকে মিলিয়ে, অথবা বলা ভালো জোড়াতালি দিয়ে, একটি ধারাবাহিক কাহিনীর জাল বুনতে শুরু করে, যা ঘুমন্ত মানুষের চেতনায় স্বপ্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ, স্বপ্ন যেমনই হোক, তার কাঁচামাল জোগান দেওয়ার দায়িত্ব, শেষ অবধি, নিখাদ বাস্তবের ওপরেই বর্তায়। অবিশ্যি, এই বাস্তব ঠিক নৈর্ব্যক্তিক-অর্থে বাস্তব নয়, বরং প্রত্যেক ব্যক্তির স্মৃতিতে ধরে রাখা বহির্বাস্তবের ব্যক্তিগত প্রতিচ্ছবিমাত্র।
অন্যদিকে, এ-কথাও ঠিক যে, স্বপ্নে দেখা ঘটনাগুলির সঙ্গে আমাদের স্মৃতিধার্য অভিজ্ঞতার একটা প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ থাকলেও, তারা কোনোমতেই আমাদের অভিজ্ঞতার হুবহু প্রতিরূপ নয়, বরং তার অতিরঞ্জিত ও বিকৃত রূপান্তর। সর্বোপরি, যে-পারম্পর্য মেনে এই ঘটনাগুলি, স্বপ্নের মধ্যে, একের পর এক উপস্থাপিত হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তির অগোচর। যুক্তি যে একেবারে নেই, তা নয়, মনঃসমীক্ষণের মাধ্যমে হয়তো এই অসংলগ্ন বিন্যাসেরও একটা সন্তোষজন ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সেই যুক্তিটি আমাদের চেতনায় ধরা পড়ে না।
একটু ভেবে দেখলে, এইখানে, কবিতার সঙ্গে স্বপ্নের গঠনগত মিল আবিষ্কার করা খুব দুঃসাধ্য নয়। স্বপ্নের মতো কবিতাও, বাস্তবের সঙ্গে একটা দ্বিবিধ সম্পর্কে অণ্বিত—সে-সম্পর্ক যুগপৎ আকর্ষণ-বিকর্ষণের। একদিকে যেমন বাস্তব থেকে সে তার অস্তিত্বের নির্যাস সংগ্রহ করে, তেমনি অন্যদিকে, বাস্তবকে অস্বীকারও করতে চায় পুরোদমে। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি।
একজন কবি যখন একটি কবিতা লিখতে বসেন, তখন তাঁর প্রাথমিক যাত্রাটি শুরু হয় ব্যক্তিগত কোনো একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। সে-অভিজ্ঞতা কখনো প্রত্যক্ষলব্ধ, আবার কখনো তা অন্যের মুখে শোনা কিংবা বইপত্রে পড়া। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার ফলে জন্ম নেওয়া মানসিক প্রতিক্রিয়া—অনুভূতি বা অভিঘাত—একান্তই ব্যক্তিগত বা প্রাতিস্বিক (সাবজেকটিভ)। আর সেই অভিঘাতটিই, একটি কবিতাকে সম্ভব করে তোলে।
শুধু যাত্রার সূচনাবিন্দুই নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছাপ ছড়িয়ে থাকে কবিতার পুরো যাত্রাপথ জুড়ে। কবিতায় ব্যবহৃত দৃশ্য, চিত্রকল্প, উপমা, উল্লেখ ইত্যাদি সবকিছুই কবির মনোজগতের সীমাদ্বারা সীমায়িত। আর মনোজগতের সীমা নির্দিষ্ট হয় একজন মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতাসমষ্টির দ্বারা। কেউ যদি খুব খুঁটিয়ে একজন কবির সারাজীবনের যাবতীয় কাব্যকৃতি বিশ্লেষণ করেন, তাহলে, আমার মনে হয়, তাঁর পক্ষে সেই কবির অভিজ্ঞতার বিস্তার বা ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটা ন্যূনতম ধারণা তৈরি করা সম্ভব। আবার অন্যদিকে, যিনি কোনোদিন ফুলের ভারে নুয়ে পড়া চেরীগাছের সৌন্দর্য—চর্মচক্ষে কিংবা ছবিতে—দেখেননি, এমনকী কোনো বইতেও পড়েননি তার কথা, তাঁর পক্ষে তাকে কবিতায় উপমা-হিসেবে ব্যবহার করা কার্যত অসম্ভব। এখানে বলে রাখা যাক, গবেষকরা বলছেন, জন্মান্ধ ব্যক্তির স্বপ্নে কোনো দৃশ্য বা দৃশ্যানুভূতি থাকে না, যেহেতু তার মস্তিষ্কে দৃশ্য বা দৃশ্যজাত কোনো স্মৃতি কখনোই লিপিবদ্ধ হয়নি। বরং, দৃশ্যের বদলে, তার স্বপ্নে জায়গা করে নেয় শ্রুতি, ঘ্রাণ, স্পর্শ ইত্যাদি অনুভূতিসমূহ।
এখন, লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা বা তজ্জনিত অনুভূতি কবিতার প্রাথমিক চালিকাশক্তি হলেও, পাঠক হিসেবে আমরা কখনোই তাকে কবিতায় হুবহু প্রতিবিম্বিত হতে দেখি না। বরং, কবিতার পাঠ থেকে কবির উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধিতে পৌঁছনোর পথটি, পাঠকের কাছে, যথেষ্ট দুর্গম বলেই বিবেচিত হয়। আমরা শুধু দেখতে পাই, একটি দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে, একটি চিত্রকল্প থেকে অন্য চিত্রকল্পে, একটি অনুষঙ্গ থেকে ভিন্ন অনুষঙ্গে, কবিতা ক্রমাগত প্রবাহিত হয়ে চলেছে, আর প্রতিহত করছে যেকোনো রকম তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যানের সহজ সম্ভাবনাগুলিকে। কবিতার বিষয়হীনতা-নামক যে প্রবণতাটির কথা প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, তার বীজ, আমার মনে হয়, কবিতার এই বিশেষ চারিত্র্যধর্মের মধ্যেই নিহিত—কোনো একটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকার পরিবর্তে, আপাত-সম্পর্কহীন বিবিধ বিষয় তথা অনুষঙ্গকে পরপর গেঁথে, একটি অন্তর্লীন অনুভূতিকে প্রকাশ করার তাগিদ। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, কবিতারও প্রকারভেদ আছে, এবং সব কবিতাই যে এমন আপাত-অসংলগ্ন চিত্রকল্পের ধারাবাহিক বুননে নির্মিত, এমনটা দাবি করার মতো নির্বোধ আমি নই। কিন্তু, এ-কথা বোধহয় বলা যেতেই পারে যে, কবিতার অন্তত একটি ধারা বা ধরণ, স্বপ্নের এই (অ)-যুক্তিপরম্পরাকে অনুকরণ করতে চেয়েছে তার নির্মাণভাবনায়। এলিয়টের ‘পোড়োজমি’ বা জন অ্যাশবেরির ‘উত্তল আয়নায় আত্মপ্রতিকৃতি’ বা রিলকের ‘দুইনো এলেজি’, এমন বিষয়হীন বিন্যাসের যথোপযুক্ত উদাহরণ। একের পর এক স্থান-কাল-দৃশ্য-চরিত্র -প্রসঙ্গ যেভাবে এই কবিতাগুলিতে চিত্রায়িত হয়েছে, অনায়াসে মিশে গেছে একে অপরের সঙ্গে, গঠনতভাবে তা কি স্বপ্নের থেকে কোনো অংশে আলাদা? মনে রাখা ভালো, কবিতার বিষয়হীনতার প্রসঙ্গটি, এবং তার আবডালে, কবিতার বিরুদ্ধে লাগাতার দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, যদিও মূলত আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তথাপি এর উদ্ভবের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন বলেই আমার মনে হয়। দান্তের ‘স্বর্গীয় মিলন’ তো আসলে একটি দীর্ঘ স্বপ্নের ধারাবিবরণীই। আবার, উইলিয়ম ব্লেকের কবিতাগুলি, বিশেষত পরের দিকের কবিতাগুলি, কবিকৃত অলঙ্করণের পাশে রেখে পড়লে, স্বপ্নে পাওয়া বলেই মনে হয় না কি?
আগেই বলেছি, কবিতার প্রকারভেদ রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে, আমরা এমনটাও দেখেছি যে, খুব সাধারণ, বাস্তবসম্মত একটি ছবির আড়ালে কবিতা লুকিয়ে রাখছে গভীরতর কোনো অর্থ বা তাৎপর্যের ঈঙ্গিত। কবিতার উপরিস্তরের অর্থ আমাদের বোধগম্য হলেও, তার ভেতরের শাঁসটিকে যেন কিছুতেই স্পর্শ করতে পারছি না। স্বপ্নের ক্ষেত্রেও কি এমনটা ঘটে না? ব্যক্তিগতভাবে অনেকবারই এমন হয়েছে যে, ভোরের দিকে, অতিসাধারণ একটি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে, অথচ তারপর, সারাদিন, একটা চোরা বিষাদ সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি। কীসের বিষাদ, তার কোনো সুরাহা হয়নি, যদিও অনুমানে বুঝেছি, সেই আপাত-সাধারণ স্বপ্নটি আসলে উসকে দিয়েছে অবচেতনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কোনো পুরোন যন্ত্রণার স্মৃতিকে। এই প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের দুটি জনপ্রিয় কবিতা—‘সোনার তরী’ আর ‘দুঃসময়’-এর কথাই ধরা যাক। বর্ষার ভরন্ত নদীর বুক চিরে চলে যাওয়া, ফসল-ভর্তি নৌকোটির আড়ালেও যে এত অপূর্ণতার বোধ লুকিয়ে থাকতে পারে, তা কি আমরা সচেতনভাবে কখনো ভেবেছি? নদীতীরে পড়ে-থাকা চাষীটির, কিংবা সেই রহস্যময় নৌকোর মাঝির আসল পরিচয় নিয়ে, উত্তর না-মেলা শতেক প্রশ্নে আমরা কি কেবলই বিব্রত হইনি? আবার, ঠিক একইভাবে, ‘দুঃসময়’ কবিতায়, সন্ধ্যার ক্রমসঞ্চরমান ছায়া যে গভীর বিপন্নতার বোধে চিত্রিত হয়, তা কি পুরোটাই বাস্তব? আমাদের যৌক্তিক চিন্তার কাঠামো কি আমাদের সত্যিই বলে দিতে পারবে “বহুদূর তীরে কারা ডাকে বাঁধি অঞ্জলি / ‘এসো এসো’ সুরে করুণ মিনতি-মাখা”?
অর্থাৎ, বক্তব্য এই যে, স্বপ্ন এবং কবিতা দুই-ই, বাস্তবনির্ভর হলেও, সেই বাস্তবের যুক্তিগ্রাহ্য অর্থগুলি চাপা পড়ে যায় তাদের প্রতীকী-তাৎপর্যের আড়ালে। বাস্তব তখন নিছক একটি চিহ্নমাত্র, যার পাঠোদ্ধার জরুরি। আর সেই পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেন কবিতার মরমী পাঠক।
রূঢ় ও কেজো বাস্তবকে একটি প্রতীকী-সত্তা হিসেবে উপস্থাপনের পেছনে ভাষার যে একটা বিরাট অবদান রয়েছে, সে-কথা নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। তবে, কবিতার ভাষা নিয়ে আলোচনার আগে, ভাষার কার্যকারিতা ও স্বপ্নের ভাষা নিয়ে দু-কথা বলা প্রয়োজন।
সন্দেহ নেই, ভাষা একটি নিতান্তই ‘কাজের জিনিশ’। ভাষা একদিকে যেমন মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম, তেমনি তা জগৎ-সম্পর্কে জ্ঞান-আহরণের একটা হাতিয়ারও বটে। আমাদের যাবতীয় বাহ্যিক অভিজ্ঞতাকে আমরা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি—এই সহজ সত্যটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখলে, এমনটা ভাবা যেতেই পারে যে, আমাদের চারপাশের বাস্তব-জগত আর আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা যেন একে-অপরের প্রতিবিম্বমাত্র। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিটি বিষয় বা বস্তুর একটি ভাষিক প্রতিরূপ রয়েছে। এবং ভাষার এই এককগুলিকে, অর্থাৎ শব্দকে, একটি নির্দিষ্ট পরম্পরা-অনুযায়ী সাজিয়ে আমরা এমন একেকটি অর্থবোধ্য বাক্য নির্মাণ করতে পারি, যা বাহ্যজগতের বস্তুগুলির পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক বা কার্যকারণের রূপটিকে আমাদের সামনে পরিস্ফূট করতে সক্ষম।
ভাষার এই ব্যবহারিক গুরুত্বটি বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত-সম্পর্কে পূর্ণত প্রযোজ্য হলেও, একেবারে ব্যক্তিগত, প্রাতিস্বিক অনুভূতির ক্ষেত্রে, ভাষা ঠিক ততখানি কার্যকরী নয়। আমাদের প্রত্যেকটি অনুভূতির একটি নিজস্ব স্নায়বিক ও বাহ্যিক প্রকাশ রয়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর, এই কারণেই, আমি যদি বলি আমার দুঃখ হয়েছে, তাহলে সে-কথা শুনে আমার স্ত্রী মোটের ওপর আমার মানসিক অবস্থাটা অনুমান করতে সক্ষম হন। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। আমার দুঃখের গভীরতা, প্রকার, রূপান্তর ইত্যাদি পুরোপুরি বুঝে ওঠা তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব হয় না, কারণ দুঃখের প্রতিটি প্রকারের জন্যে আলাদা আলাদা নাম দেওয়া আমাদের ভাষার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং, সমস্ত দুঃখকেই সে ‘দুঃখ’ নামক একটি সাধারণ বর্গ-দ্বারা চিহ্নিত করে। ঠিক একইভাবে, পৃথিবীর সমস্ত আমগাছের জন্যে ভাষায় একটিমাত্র প্রতিরূপ থাকলেও, বাড়ির ঠিক পেছনের আমগাছটির প্রতি আমার যে স্মৃতিবাহিত দুর্বলতা, যা তাকে আমার কাছে স্বতন্ত্র করেছে, তাকে ভাষায় প্রকাশ করা ও অন্যের কাছে অর্থবোধ্য করে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
স্বপ্ন ঠিক এমনই একটি ক্ষেত্র, যা পুরোপুরি আমাদের প্রাতিস্বিক চেতনানির্ভর। কেননা, একজন মানুষের আজীবন সঞ্চিত স্মৃতিই তাঁর স্বপ্নের একমাত্র অবলম্বন। তাহলে, স্বপ্নের দুনিয়ায় ভাষার গুরুত্ব ঠিক কতখানি? তা কি বাস্তবজগতের মতোই অকাট্য কার্যকারণসূত্রে গ্রথিত? বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, স্বপ্নে আমরা যে ভাষাগত উপাদানগুলির সম্মুখীন হই, মূলত সংলাপের আকারে, তার গড়ন ও বিন্যাস, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, জাগ্রত-অবস্থায় সচেতনভাবে নির্মিত বাক্যের অনুরূপ। স্বপ্নে উচ্চারিত অধিকাংশ বাক্যেরই নিজস্ব একটি সুস্পষ্ট অর্থ রয়েছে। অথচ, এই বাক্যগুলি তৈরি হচ্ছে আমাদের অজ্ঞাতসারে, যেখানে আমাদের ঐচ্ছিক নিয়ন্ত্রণের সামান্যতম সম্ভাবনাটুকুও নেই। আর সেই কারণেই, বাক্যগুলি স্বতন্ত্রভাবে অর্থবোধক হলেও, স্বপ্নে সংঘটিত ঘটনা ও প্রেক্ষিতের সাপেক্ষে তাদেরকে প্রায়শই আজগুবি ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। অর্থাৎ, স্বপ্নে আভাষিত দৃশ্য বা অনুভূতি এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভাষিক উপাদানগুলির যে খুব গভীর যোগসূত্র রয়েছে, এমনটা সবসময়ে সত্যি না-ও হতে পারে।
যেহেতু কবিতাও কবির ব্যক্তিগত মানসিক অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে, তাই তার সঙ্গে ভাষার সম্পর্কটিও কিঞ্চিত গোলমেলে। এ-কথা আমরা সবাই জানি যে, কবিতার ভাষা আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহারিক ভাষার থেকে আলাদা। কিন্তু ঠিক কোনখানে এবং কীভাবে আলাদা, সেটা বুঝে নেওয়া এই মুহূর্তে জরুরি বলে মনে হয়।
ধরুন, জীবনানন্দ লিখলেন ‘উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা’। এখন, উটের গ্রীবার সঙ্গে নিস্তব্ধতার যে আদৌ কোনো যুক্তিগ্রাহ্য সম্পর্ক রয়েছে, এমন নয়। ফলে, আমাদের ব্যবহারিক ভাষার সাপেক্ষে, এই শব্দবন্ধটি অর্থহীন বলেই বিবেচিত হবে। কিন্তু, জীবনানন্দ বলতে চাইছেন একটি বিশেষ ধরণের নিস্তব্ধতার কথা, যা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনুভব করেছেন। ভাষার সাধ্য কী, যে সে এই বিশেষ-ধরণের নিস্তব্ধতাটিকে একটি আলাদা শব্দে চিহ্নিত করে! তার কাছে যেকোনো শব্দহীনতার ওই একটিই প্রতিরূপ—নিস্তব্ধতা। ফলে, নিজের ব্যক্তিগত নিস্তব্ধতাটিকে ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়াসে, তাকে সর্বজনবোধ্য করে তোলার তাগিদে, ভাষার যুক্তিকাঠামোর বিরুদ্ধে একটি গোপন অন্তর্ঘাতে লিপ্ত হওয়া ছাড়া, কবির সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না। প্রথমত, শব্দকে তিনি বের করে আনেন তার প্রচলিত বাচ্যার্থের নিগড় থেকে, আর দ্বিতীয়ত, তিনি এলোমেলো করে দেন বাক্যের প্রথাগত যুক্তিশৃঙ্খল। একটি বাক্যকে, আপাতসম্পর্কহীন আরেকটি বাক্যের পাশে বসিয়ে, তার থেকে নিষ্কাশন করতে চান তৃতীয় একটি অর্থের সম্ভাবনা, যা হয়তো তাঁর অনুভূতিকে আরেকটু বিশদে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে। আর এইখানেই, কবিতার ভাষা ক্রমশ প্রতীকী হয়ে ওঠে, ব্যবহারিক ভাষার থেকে ক্রমশই আরো দূরে সরে যেতে থাকে।
এখানে একটি বিতর্ক উঠতে পারে যে, স্বপ্ন যেমন পুরোপুরি একটি অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়া, কবিতাও কি তাই? যদিও অটোম্যাটিক রাইটিং বা স্বতোলিখন বলে একটি ধারা একদা ইয়োরোপীয় কবিতায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তথাপি, আমি কবিতার নির্মাণ ও শৈলীর দিকটিকে খর্ব করতে একেবারেই নারাজ। আমি শুধু এটুকুই বলতে চেয়েছি যে, কবি তাঁর কবিতার জগতটিকে নির্মাণ করেন স্বপ্নের আদলে, কতকটা তার সচেতন অনুকরণের প্রয়াসে। এটা শুধু কবির খামখেয়াল নয়, বরং, প্রাতিস্বিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক ভাষার সীমাবদ্ধতা, কবিকে এই পথ অবলম্বন করতে একরকম বাধ্য করে।
কবিতা ও স্বপ্নের পারস্পরিক নৈকট্য নিয়ে যে-আলোচনা এতক্ষণ ধরে জারি রইল, তার মূল ভরকেন্দ্রটি ছিল কবিতার নির্মাণ। এখন, আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে, কবিতার সেই মরমী পাঠকের দিকেও একবার ফিরে তাকানো যাক। কবিতার ভাষা যেহেতু প্রতীকী, ফলে তার অর্থোদ্ধারের দায়িত্ব অর্শায় কবিতার পাঠকের ওপর। যেভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক তার আভ্যন্তরীণ সংবেদনগুলিকে স্মৃতিধার্য বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যায় উপনীত হতে চেষ্টা করে, ঠিক সেভাবেই কবিতার পাঠক কবিতায় বিবৃত দৃশ্যাবলীকে নিজের পূর্ব-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট অর্থে, বা অনুভূতিতে উপনীত হতে সচেষ্ট হন। যদি ধরে নিই, কবি তাঁর অনুভূতিকে প্রকাশ করেছিলেন একটি নির্দিষ্ট ভাষিক সঙ্কেতের মাধ্যমে, তাহলে পাঠকের ভূমিকা সেই সঙ্কেতের পাঠোদ্ধারকারীর। যেহেতু পাঠকের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির পরিধি, কবির অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির পরিধির থেকে অনেকাংশেই আলাদা, ফলে পাঠকের পাঠ কবির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলে যাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথবা, কবি ও পাঠককে একই মানুষের নিদ্রিত ও জাগ্রত সত্তা বলেও বিবেচনা করা যায়, অবশ্যই আলঙ্কারিক অর্থে। নিদ্রিত অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক তার অবচেতন খুঁড়ে এমন সব স্মৃতি ও অনুভূতিকে তুলে আনে, জাগ্রত অবস্থায় যার হদিশ পাওয়া মানুষের পক্ষে একান্তই অসম্ভব। ফলে, জেগে ওঠার পর, মানুষ যখন সচেতনভাবে তার স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হয়, তখন সেই ব্যাখ্যা স্বপ্নের আসল তাৎপর্যের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। ফলে ‘জাগ্রত’ পাঠকের ‘সচেতন’ পাঠ, ‘নিদ্রিত’ কবির ‘অবচেতন’ নির্মাণের থেকে প্রায়শই আলাদা
একজন মানুষের স্বপ্ন যেমন আরেকজন দেখে ফেলতে পারে না, তেমনি একজন কবির কবিতাও আরেকজন কবির পক্ষে অজান্তে লিখে ফেলা সম্ভব নয়। যদিও, সজ্ঞান অনুকরণ সম্ভব। আবার, একই কবিতা পড়ে, একজন পাঠকের হৃদয়চাঞ্চল্য আরেকজন পাঠকের পক্ষে অনুধাবণ করাও ঠিক ততোটাই কঠিন। এখানেই কবিতার রহস্য, তার অযৌক্তিক সৌন্দর্য—আয়নায় ফুটে ওঠা তার আধোলীন বিদ্রূপের হাসি।