পুয়াতি রেণু
পান্না আকন্দ


নিঃস্বব্দতার আকাশ বেয়ে নেমে আসে নৈসর্গের দুঃখেরা
হলুদ ফসিল মাঠ পেড়িয়ে দুঃখ উঠে আসে শকুন্তলা গ্রামে,
জারুলের শুকনো পাতায় মরমর শব্দে বাজায় জীবনের
করুণ সুর।  


মরা গাঙের পর দুটি মাঠ আর ঘন জঙ্গল  ছাড়িয়ে শিমুলহাটিতে বিয়ে হলো রেণুর।
বিয়েতে দেওয়া হলো নগদ বিশ হাজার টাকা ও দুটি হালের গরু,
চড়া সুদের টাকায় কেনা হলো কাঁঠালগাছের বানানো আসবাবপত্র।


রেণুর নতুন জীবন গুছাতে বজলু শেখ  বাড়ির ভিটে বন্ধক রেখেছে,
পাকা ধান ক্ষেতে রেখেই বিক্রি করেছে বেপারীর কাছে
নতুন জামাই আর সব আত্মীয় স্বজনের মুখতো রাখা চাই!


রেণুর বিয়ের ছয় মাস গেলো,নাইওর আসে দ্বিতীয় বার
বাবা মেয়ের সংসার জানতে চায়' মা-রে  হউর-হউরি তরে বালা পায়তো'?
'হালের গরু দুই ডা বালা আছে ,খাট-পালঙ্ক তোর পছন্দ হয়ছে তো'?


রেণু নীরবে চোখ মুছে বলে ' বাজান গো তোমাগোর জামাই গরু দুইডা বেইচ্চালাইচে,
আর কইছে এবার দশ হাজার টাকা না লইয়া গেলে আমারে রাখবো না'
'বাজান গো তোমার নাতি আইচে আমার পেটে,কি করবা?


বজলু শেখ রাতভর চিন্তা করে,ভাবে অনাগত নাতির কথা
খোঁজে চলে মা মরা মেয়ের সংসার করানোর কথা,
দুদিন পর' মা-রে তুই জামাইরে গিয়ে 'ক' আমি আইতাছি কয়দিন পর'।


রেণু যায় আর অপেক্ষার দিন গুণে দৈনিক দৈহিক অত্যাচার এর বিনিময়ে,
ননদ শাশুড়ির কথার ঝড় উঠে মাঝেমধ্যে বন্ধ হয় খাবার
তবুও বজলু শেখ টাকা জোগাড় না করতে পেরে যায়না শিমুলহাটিতে।


হঠাৎ একদিন সাত মাসের পুয়াতি মেয়ে ফিরে আসে শকুন্তলায়,
' বাজান গো আর পারিনে সইতে লাত্থি গুতো,না খেয়ে থাকতে,
তুমি তো গেলানা,কলিজা কামড়ে ছিঁড়ে, দেহ আঙার করে বেতের ঘাঁ-য়ে।


বজলু শেখ শুনে রেণুর আর্তনাদ  তবুও কাঁদতে পারে না,
চোখের পানিতো শেষ হয়েছে রেণুর মা মরার সাথে সাথে
মনে মনে বলে'এই দেহ আর আত্মা ছাড়া তোর বাজানের কিচ্ছু নাইরে রেণু'।


ভোর রাতে আচমকা রেণু চিৎকার করে' বাজান গো মইরা গেলাম,
বাজান গো হাত পা খিচুনি দিতাছে, তলপেট বেদনায়  ফাইটা যায়'
বাজান গো ডাইক্কা আনো ছোড্ দাদুরে,তাড়াতাড়ি যাও গো বাজান'।


বজলু শেখ দৌড়ে গিয়ে বলে'ছোড্ চাচী গো তাড়া কইরা আঈন,
আমার রেণু জানি কিরম করতাছে,আমার মাইয়্যাডারে বাচাইন'
'মা মরা মাইয়্যা আমার, কেমন জানি নীল হইয়া যাইতাসে'


শমসের এর মা রেণুকে দেখে বলে' আব্বাজী রেণুর তো প্রসব ব্যাথা, সময়ের আগেই
আমারে গরম পানি  আর একটা নতুন সাবান -ব্লেড
দেইন, আর আল্লারে ডাহেন'
সাত মাসের পুয়াতি আল্লাই একমাত্র রক্ষার মালিক, গতি ভালানা'


প্রসব ব্যাথা আর অপুষ্টিতে শুরু হয় রেণুর খিচুনি যাকে বলে 'এক্লামসিয়া'
রেণুর চিৎকারে চিৎকারে ভোরের শুকাতারা আকাশে বিলিন হয়
"দাদী গো আমারে বিদায় দাও,আমার মা যে আমারে ডাহে'।


ভোর রাত থেকে দিন শেষ হয়ে আসে, সেই সাথে শেষ হয় রেণুর চিৎকার
সতের বছরের পুয়াতি রেণু পুয়াতিই থেকে যায়,
সাড়া দেয় মায়ের ডাকে পরপারে,ক্ষতবিক্ষত দেহ ও মনে।


এভাবেই হাজারো পুয়াতি রেণু যৌতুকের চাপাকলে পাড়ি দেয় পরপারে
তবুও টিকে থাকে যৌতুক আর অত্যাচারী অস্পষ্ট মুখ গুলো,
আর বজলু শেখের মতো বাবারা নীরবে সন্তানের দাফনের কাপড় সেলাই করে।
৯ মে ২০২০