চুহাত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় আমি ন’বছরের।


রেলওয়ে স্টেশন-
দুই-আড়াই বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে-শিশু ডুকরে কাঁদছিলো।
তাকে ফেলে গেছে কোন অভাগী মা অথবা বাবা
অথবা আর কেউ!


ক্ষুধাও ছিলো তার পেটে।
দশ/বারোটি উৎসুক চোখ তাকিয়ে ছিলো- নির্বিকার! অথচ
সেই চোখগুলো ঘিরে স্নেহ-মমতার কোন ছায়া ছিলো না।
দু’জন খাকি পোষাকধারী (এক জনের কাঁধে বল্টু)
টি-ষ্টলে-আয়েশী ভঙ্গিতে-
কাপ থেকে প্রীজে চা ঢেলে পান করছিলেন। এমন দুর্দিনেও-
তারা ছিলেন, প্রানবন্ত সতেজ!
তাদের সরকারী চাকুরী, মাস গেলে মায়না!
তবু...তারা বেশীক্ষন একদিকে চেয়ে থাকতে পারেন না। আগত যাত্রীদের-
তল্পা-তল্পিতে ঘুরে বেড়ায় চঞ্চল চোখ...


মেয়েটি কাঁদছেই, ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে কন্ঠ! ওদিকে-
ঢং_ঢং_ঢং  টিং-টিং-টিং! ট্রেন আসার বার্তা,
যে যার মতো ব্যাস্ত হয়ে পড়েন।


শুধু ব্যস্ততা উবে যায় লাল-পোষকধারী কুলি রোস্তম আলী।
পায়ে পায়ে তিনি এগিয়ে আসেন মেয়েটির কাছে  
কি যেন-জিজ্ঞেস করেন, তারপর...
ছেড়া ফতুয়ার পকেট থেকে শেষ সম্বলটুকু দিয়ে-
একটি পাউরুটি কিনে দেন মেয়েটিকে।
কান্না থামিয়ে খেয়ে নেয় সে গো-গ্রাসে।
-কে আছে তোমার সাথে?
তার ভেজা চোখ দুটি এদিক ওদিক খোঁজে কাউকে। আবার-
ডুকরে কেঁদে ওঠে!
রোস্তম আলী তার মাথায় শান্তনার হাত বুলোয়। বুলোতেই থাকেন।
ঘরে তাঁর তিন-তিনটি মেয়ে! সকালে এক-পোয়া আটা
নুন-জলে রেঁধে খেয়ে আছে তারা।


ওপাশে পাটগ্রামগামী ট্রেনটি এসে থামে প্লাটফর্মে। যাত্রীদের সাথে
লাল-পোষাকধারী রোস্তম আলীর সহকর্মীদের ছুটোছুটি, ব্যস্ততা।
তাঁর ব্যস্ততা শুরু হয় অবুঝ শিশুটিকে নিয়ে...
ঘরে চাল নেই, নুন নেই, বড় আশা বুকে বেঁধে-
হা-করে রয়েছে কয়েকটি ক্ষুধার্থ মুখ...বাবা আসবেন, গামছায়
বেঁধে নিয়ে খাবার...


ট্রেন ছেড়ে গেলে ক্রমশঃ ফাঁকা হয়ে যায় চারদিক,
কেউ আসেনা মেয়েটিকে নিতে, অগ্যতা-
তাকে কোলে তুলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় কুলি রোস্তম আলী।