কুড়ি বছর পর আজ যাচ্ছি নবাবগঞ্জে -
আমার বিশ্বস্ত প্রেমিকা মহানন্দার কাছে;
ট্রেনে চাপতেই আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে রোমহর্ষ অনুভুতি!
প্রৌর চোখে ফিরে এলো তাগড়া যৌবনের তিগ্মে দ্যুতি ;
দেবী প্রতিমার মতো ঝলমল করে ভেসে উঠলো মহানন্দার কিশোরী-মুখ।
কুড়ি বছর ধরে এই প্রস্তর এই চোখ ধারণ করে আছে  অগণিত স্মৃতি!


এখনো প্রতিটি নবাগত বসন্ত আমাকে ব্যকুল করে তুলে!
বসন্তে রঙে কৃষ্ণচূড়ার পর্ণে-পর্ণে তাকে কবিতা লিখে দিবো বলে;
স্মৃতির প্রজাপতি উড়ে উড়ে চলে যায় আম তলার স্নিগ্ধ ছায়ায়
নিরিবিলি মুহুর্তের খুঁজে !
যবে ক্লান্ত বিকেল এসে হেলে পড়তো পুকুর ঘাটে
পড়ন্ত বিকালে মহানন্দার সে কি দুরন্ত খুনসুটি!
আজো প্রতিটি বিকাল আমাকে বড্ড তাড়া দেয়
ইচ্ছে করে সে-দিনের মতো আকাশের বুকে মেঘের মাঝে
রংধনুর রঙে-এঁকে দিই সন্ধ্যার ঝিলমিল সাঁঝে প্রেমের রাঙা আলপনা;


আখাউড়া ষ্টেশন থেকে সুট-টাই পড়া এক ভদ্রলোক উঠেলেন,-
বারংবার আমার শ্মাশ্রুময় বিষন্ন মুখের দিকে বিস্ময় চোখে তাকাচ্ছেন!
অকস্মাৎ বলে উঠলেন, " আপনি কবি'দা, না? "
হতভম্ব হলেও চিনতে পারলুম ভানু কাকার ছোট ছেলে -
বাকি পথটুকু ওর সাথে গল্প করেই জানলুম
নবাগঞ্জের উন্নতির কথা, মানুষের মধ্যে এসেছে সভ্যতার ছোঁয়া! বিরাট পরিবর্তন
মোরগ চোর মতি মিয়া এখন গাঁয়ের বড় মাতব্বর,
লম্পট নেপেন্দ্র বিদ্যাপীঠের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি;
সাসপেন্ডেড রমিজ মাষ্টার প্রমোশন পেয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক!
সুদখোর মহাজনের ছেলে বিলেত ফেরত নামীদামি ব্যারিস্টার ;
কুখ্যাত রাজাকের পৌত্র ক্ষমতাসীন দলের বিরাট নেতা!
ভূমি খেকো হানিফ মুন্সী অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড।


আমার কুড়ি বছরের লালিত স্বপ্ন-
মহানন্দাকে নিজ হাতে পড়াবো বলে খুব যত্নে রেখেছি, -
একটি সিঁদুরের কৌটো আর মঙ্গলসূত্রের মালা;
রাতের অন্ধকারে বিদারণ করে ট্রেন চলছ আমার দু'চোখ ভরা স্বপ্ন টেনে টেনে!


নবাবগঞ্জ পৌঁছালুম।নেমেই ধরলুম হাঁটা,সবকিছু কেমন অচেনা!
রাস্তার কি বেহালদশা ভাঙাচুরা গোবি-মরু পথের চেয়েও দুর্গম!
হেঁটে তো চলছিই তা-ও আবার এক রুষ্ট প্রভাতে;
পাখিদের ঝাঁক নাই, ডাক নাই, কোন শুভেচ্ছা বার্তা নাই!
চাঁপা বনে চাঁপা নাই, সুবাসিত হাওয়া নাই- কিচ্ছু নাই।
প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো ধ্বসে পড়ছে পুরো নবাবগঞ্জ।
বাড়িতে পৌঁছে তো আরো বিস্মিত হলুম!
সবকিছুই বদলে গেছে,কোথাও কোন স্মৃতি চিহ্ন নাই!
রিয়েল এস্টেট কোম্পানি পুকুরটি ভরাট করে নির্মাণ করেছে বহুতল ভবন ;
আম তলার এক পাশে বিশাল মার্কেট আরেক পাশে মদের কারখানা !
এখানে আজ বসন্ত মৃত, কৃষ্ণচূড়া বর্ণহীন,
পুকুর ঘাটে বৈকালী রোদের ঝিকিমিকি হাসি নাই;
আমতলার স্বাচ্ছন্দ্য ছায়া নাই,স্নিগ্ধ-বিশুদ্ধ বাতাস নাই,
উৎকট অস্বস্তিকর পরিবেশ  !  
দিন দুপুরে অন্ধকারাছন্ন একটি ভূতোরে বাড়ি!
এক পাশে কৃষ্ণচূড়ার  গোড়ায় তরু লতায় বেষ্টিত চৌপ্রাচীরের ভিতরে
চাপা পড়ে আছে ;আমার কুড়ি বছরের লালিত স্বপ্ন,
আমার অসম্পূর্ণ প্রেম,আমার মহানন্দার -
নিথর নিঃপ্রাণ অশরীরে অপেক্ষার শ্রান্ত চোখ!