সেদিন মৃদু কুয়াশার বিকেলে মেহগনি বেষ্টিত মেঠোপথ ধরে আমি শীতের গন্ধ গায়ে মেখে হেঁটেছি বহুক্ষণ।বহুদূর থেকে শীতল হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছিলো গুড়ের মিষ্টি ঘ্রাণ।সে ঘ্রাণকে আর তরতাজা করে তুলতে যোগ দিয়েছিলো খেজুরের রসের ঘ্রাণ।রসের হাড়িতে বসে রস পানের সঙ্গে সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছিলো একজোড়া শালিক।


পাশে সরু খালে নৌকা বাইতে দেখলাম এক ছোট্ট মেয়েকে।তাকাতেই একটি প্রাণবন্ত হাসিতে মেঘলা বিকেলকে আলোকিত করে তুললো সে।হয়তো তাড়া ছিল তার,তাই হাসির পরে এক মুহূর্ত নষ্ট না করে এগিয়ে গেলো নিজ গন্তব্যে।
আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছিলো ধানহীন শূন্য ক্ষেতের উপরের কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকা বকের দল।কুয়াশায় ডুব দিয়ে আবার বেড়িয়ে আসতো বাইরে।তবে,শেষবার তারা ডুব দিয়ে আর উঠে আসেনি।


ক্ষেতের ছোট্ট জলাশয়টিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাশের মাথায় একা বসে আছে ফিঙে,তার আশেপাশে কোথাও তার নিজ কেউ নেই।ঠাঁয় বসে থাকা ফিঙেটি হঠাৎ কী মনে করে তাকালো আমার দিকে!যেন কিছু বলবে আমাকে,আমিও তার দিকে নির্বাক বন্ধুর মতো তাকিয়েছিলা।বলতে চেয়েছিলাম কথা চোখের ভাষায়।কিন্তু ফিঙে মানুষের চোখের ভাষা কী করে বুঝবে,তাই সে মাথা ঘুরিয়ে না জানি কোথায় চলে গেলো মুহূর্তেই।সেও চলে গেলো।


সেদিন সারাটা বিকেল অনেক হেঁটেছিলাম,দেখেছিলাম ডানে,বামে,উপরে,নিচে।প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন কর্মের।
কিন্তু,আমার জানা ছিল না আমার পিছনের গল্প।


ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে সে মেঠোপথে এক জোড়া চোখ দেখেছি,যে চোখ জোড়া গিলে খাচ্ছিলো এই পৃথিবীর সন্ধ্যার কুয়াশার দৃশ্য।
কুয়াশা ও মেঘের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ডুবন্ত সূর্য যেন অনন্তকালের জন্য তার দৃষ্টিকে কিনে নিয়েছিলো সৌন্দর্যের বিনিময়ে,আর আমার দৃষ্টি কিনেছিল সে।
একই সময়ে আমাদের দু'জনের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা ঘটেছিলো সন্ধ্যায়।আমার উভয়েই এমনভাবে তাকিয়েছিলাম যেন,এক কোটি বছর অপেক্ষা করেছি এমন দৃশ্য দেখার জন্য।


নির্জন নিস্তব্ধ মেঠোপথে আমরা দু'জন।একজন জানে না আরেকজনের উপস্তিতি।সে নিস্তব্ধতার বাগানে আমি শুনেছি তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস,শুনেছি নিশাচর বোলতার পাখার আওয়াজ।তবে শুনতে পারিনি পৃথিবীতে ক্রমশ ধেয়ে আসা কলঙ্কিত অন্ধকারের শব্দ।
নিশব্দে,ধূর্ততার সাথে চোখে ঢেলে দিয়েছিলো আঁধারের ধূলো।আর দেখিনি তাকে।


আঁধার বাড়লো,কুয়াশা বাড়লো,বাড়লো অসীম দূরত্ব।শত ক্রোশ এগিয়েও পেলাম না তাকে,যেন সে শুধু লুকানোতেই মত্ত।


ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার সল্প আলোয় দেখেছি ক্ষণিকের গল্প।