১৬-০২-২০১৯ খৃঃ তারিখে পরিবাগ সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের হল রুমে অনুষ্ঠিত হলো বাঙলা কবিতার আসরের ১৬তম আসর এবং কবিদের মিলন চক্র অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন আসরের বিশিষ্ট কবি খলিলুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আসরের নিভৃতচারী বিশিষ্ট কবি ফারহাত আহমেদ এবং  বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের গবেষক কবি ড. এম মোস্তাকুল হক।


ব্যক্তিগত কিছু ব্যস্ততার কারণে অনুষ্ঠানটিতে অনুপস্থিত থাকবো এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল। আসরের আরেক কবি চাঁছাছোলা (সোহাগ আহমেদ) খুবই মর্মাহত হলেন আমার এ সিদ্ধান্তের খবরে। এর মধ্যেই আসরের পাতায় ঢুকে জানতে পারি কবি খলিলুর রহমান আসছেন দেশে। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলি। যাবতীয় ব্যস্ততাকে আয়ত্তে এনে ছুটে যাই ১৬ তারিখের অনুষ্ঠানস্থলে।


তার দু দিন আগে কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, কবি কবীর হুমায়ূন, কবি রঞ্জুসহ আমরা বসি কবি সোহাগ আহমেদের অফিসে। ১৬ তারিখের অনুষ্ঠান নিয়ে হয় আলোচনা, পরিকল্পনা। কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল জানালেন আসরের নিভৃতচারী কবি ফারহাত আহমেদ আমাদের অনুষ্ঠানে আসতে সম্মত হয়েছেন। এটা জেনে আমি আরো উল্লসিত বোধ করি কারণ তিনি আমার কবিতার গুরু যাকে আমি কখনোই সামনে থেকে দেখার সুযোগ পাই নি।


গুরু দর্শনের আকুল আকুতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে পৌছেই প্রচন্ডরকম ধাক্কা খাই যখন কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল জানান গতকাল থেকে কবি ফারহাত আহমেদ ফোন রিসিভ করছেন না। যা হোক নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুক্ষণ পরে শুরু হয় আসরের কার্যক্রম। আসরে সভাপতিত্ব করেন আসরের বিশিষ্ট কবি আমার প্রিয় দাদাভাই কবীর হুমায়ূন। সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন আসরের আরেক বিশিষ্ট কবি মনিরুজ্জামান।


শুরুতেই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন  কবি মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন। প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথির আগমনে কিছুটা বিলম্বের কারণে স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আসর এগোতে থাকে। কবি রুনা লায়লা, কবি সরদার আরিফুদ্দিন সহ বিশিষ্ট্য কবিদের অসাধারণ কবিতা পাঠে যখন মগ্ন হঠাৎ দৃষ্টি যায় দরজার দিকে। কেউ একজন ঢুকলেন অনুষ্ঠানের হলরুমে, নীরবে বসলেন একদম পেছনের চেয়ারটাতে। আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মুহুর্তেই আমার ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে উঠলো। ইনিই তো আমার সেই অদেখা কবিতার গুরু ফারহাত আহমেদ যিনি প্রতিনিয়ত আমাকে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা/উৎসাহ যোগাতে কখন স্নেহচ্ছলে কথা বলেছেন, কখনো শাসনের সুরে কথা বলেছেন। যে মানুষটির সাথে যোগাযোগ না হলে কস্মিনকালেও জানতে পারতাম না আমি আদৌ দু কলম কবিতা লিখতে পারি।


আমার অনুভূতি আর কাজ করছিল না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি; কেউ একজন বলে উঠলেন আমাদের বিশেষ অতিথি চলে এসেছেন। আমিসহ সবাই বিশেষ অতিথিকে বরণ করে নেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমার কবিতার গুরু বিশেষ অতিথি হেঁটে আসছেন সামনে, আসরের সভাপতি হাত বাড়িয়ে তাঁকে উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন, তিনি তার নির্ধারিত আসরে বসলেন। আমি তাকিয়ে আছি, কানে আসলো গুরু বলছেন, "পেছনেইতো আমি ভাল ছিলাম"। আমি তাকিয়েই আছি। বহুদিনের আশা গুরুকে এক নজর একটু দেখবো, তার পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেবো। আজ তার কিছুই করা হলো না। আমি অসাড় হয়ে বসে আছি, আমার করণীয় কী তাও ভাবার মতো অবস্থায় আমি নেই। গুরু যে গুরু তিনি সেটাই প্রমাণ করলেন আবার। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি ভাল আছেন"? প্রতিউত্তরে আমি মাথা নেড়ে জানাই আমি ভাল আছি।


ইতোমধ্যেই সপত্নীক হাজির হন আসরের প্রধান অতিথি কবি খলিলুর রহমান। বিশেষ অতিথিসহ প্রধান অতিথিকে আসরের ব্যাজ পরানো হয়। আসরের আনন্দ যেন এতক্ষণে পূর্ণতা পায়। কবি খলিলুর রহমান মানে সদাহাস্য এক আলোকজ্জ্বল মুখ যার উপস্থিতিই এনে দেয় আনন্দের এক অন্য অনুভূতি। প্রধান অতিথিসহ বিশেষ অতিথিকে চা দিয়ে আপ্যায়ণ করেন কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল আর কবীর হুমায়ূন। কবীর হুমায়ূন এর "এক কাপ চা ভাগাভাগি"র সূত্র আসরে হাসির বন্যা বইয়ে দেয়। আসরে পুরো ঘরোয়া পরিবেশ জমে উঠেছে। চা বিরতির কারণে স্বরচিত কবিতা পাঠ স্থগিত রাখা হয়। আমার কবিতার গুরু কবি ফারহাত আহমেদ দু হাত তুলে ঘোষণা দেন তার চা খাওয়া শেষ। তাঁর স্বরিচত "ফুলচোর" কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আবার শুরু হলো পাঠচক্র। পর্যায়ক্রমে কবিতা পাঠ করেন কবি চাঁছাছোলা (সোহাগ আহমেদ), কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, কবি কবীর হুমায়ূনসহ বিশিষ্ট কবিগণ। পাঠচক্রশেষে প্রধান অতিথিসহ বিশেষ অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর মুহুর্ত আসে।


কবি রুনা লায়লা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের মাধ্যমে বরণ করে নেন প্রধান অতিথি কবি খলিলুর রহমানকে। কবি খলিলুর রহমানকে দিয়ে তার পত্নীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর অসাধারণ আইডিয়াটা আসে দাদাভাই কবীর হুমায়ূনের কাছ থেকে। এরপরেই যখন বিশেষ অতিথিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আমার নাম ঘোষণা করা হয় তখন আমার আনন্দ সীমানা অতিক্রম করে ছুটতে থাকে অসীম দিগন্তে। আকর্ণ দন্তবিকশিত করে ফুল নিয়ে এগিয়ে যাই আমার কবিতার গুরুর দিকে। গুরুর হাতে ফুল তুলে দিচ্ছে তার শিষ্য, গুরুর কেমন লেগেছে জানি না, তবে শিষ্য হিসেবে আজকের আসরের উদ্যোক্তাগণের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম আমাকে এই বিরল সুযোগ প্রদানের জন্য।


কবি রুনা লায়লার একক কাব্যগ্রন্ত "নিয়তির ডুবোচর" সহ আসরের এগারজন কবির কাব্যসংকলন "জলতরঙ্গে কাব্যভেলা"র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। তার আগেই আসরের আরেক বিশেষ অতিথি কবি ড. এম মোস্তাকুল হক এসে উপস্থিত হন আসরে। তাঁকেও ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে কবি ফারহাত আহমেদ তার পেশাগত ব্যস্ততার কারণে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাঁর ব্যস্ততাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আসরের সভাপতি ফটোসেশন শেষ করেন।


বিদায় নিচ্ছেন আমার কবিতার গুরু আসরের বিশেষ অতিথি ফারহাত আহমেদ, তাঁকে এগিয়ে দিতে সাথে যান কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল আর কবি সোহাগ আহমেদ। চকিতে অনুভব করি গুরুর বিদায়মুহুর্তে আমার এগিয়ে না যাওয়া শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাই গুরুর কাছে। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দুই গুনী কবির (কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল আর ফারহাত আহমেদ) আলাপচারিতা জমে ওঠে। আলাপে তারা দুজনে এতটাই মশগুল যে আমার কবিতার গুরু সিঁড়ির শেষ সীমানায় পা রেখেছেন তা তাঁর খেয়ালেই নেই। মুহুর্তের অসাবধানতায় বিপদ আঁচ করে কবি সোহাগ আহমেদকে সে দিকে ইঙ্গিত করি। কবি সোহাগ আহমেদ দ্রুত কবির পেছনে যেয়ে দাঁড়ান। যেতে নাহি দেবো হায় স্টাইলে আলাপশেষে বিদায় নেন আমার কবিতার গুরু। আমি দাঁড়িয়ে মনে মনে তাঁকে প্রণাম জানাই।


ফিরে আসি হলরুমে। কবি ড. এম মোস্তাকুল হক তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দিয়ে সবাইকে আটকে রাখলেন কিছুক্ষণ সময়। তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রধান অতিথি কবি খলিলুর রহমানের অনুভূতি আর কবিতা পাঠ পর্ব। তিনি তাঁর সরল আর সুন্দরভাবে যাপিত জীবনের কথা কাব্যিক ভাষায় তুলে ধরলেন আমাদের সামনে। মুগ্ধ হলাম সেই পুরোনো নিয়মে। সময়ের ডাকে সভাপতি আসরের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।


বাঙালিয়ানা আপ্যায়নে আপ্যায়িত করা হলো আজকের আসরের আগত কবিসহ অতিথিগণকে। তারপর নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা। কবি খলিলুর রহমানের অটোগ্রাফসহ তাঁর কবিতার বই "বেলা শেষে রঙ" এবং "যে স্মৃতি কথা বলে" ছিল বাড়তি প্রাপ্তি।


এরপর বাঙলা কবিতার আসরের ব্যানার নিয়ে পায়ে হেঁটে কবিগণ রওয়ানা দেন বাঙালির প্রাণের মেলা একুশে বই মেলার উদ্দেশ্যে। গৌরব প্রকাশনীর স্টলে যেয়ে উপস্থিত হন কবিগণ। গৌরব প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বই দেখেন সবাই, কেউ কেউ কিনেও নেন। তাঁরপর আবার ছবি তোলার মহড়া। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। আঁধার দূর করতে জ্বলে উঠেছে মেলায় থাকা শত শত বৈদ্যুতিক বাতি। জীবন জীবিকা আর সংসারের তাড়নায় বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। একে একে পরস্পরের কাছ থেকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিতে থাকে।


আবার দেখা হবে ১৭তম আসরে, আবার বাজবে মিলনের মধুর সানাই সেই প্রত্যাশায় আমিও পথ ধরে হেঁটে এগোই সম্মুখপানে।