[উৎসর্গঃ স্বাধীনতার সূর্যসৈনিকদের]


বাবা ও বাবা তুমি কোথায় লুকিয়ে আছ?
বাবা, বাবা দেখ, আমরা তোমার সন্তান
তোমার অপেক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি তীর্থের কাকের মতো
বাবা আমাদের জন্য স্বাধীনতা আনতে গিয়ে
তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে?


জান বাবা, প্রত্যেক ভোরে মর্নিং ওয়াকের নাম করে
দাদু আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। পথের ধারে
কিংবা কোন উদ্যানের সুশীতল গাছের ছায়ায়
উসকো খুশকো চুলে জবুথবু হয়ে শুয়ে থাকা
দিকভ্রান্ত বৃদ্ধদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন
তাদের মাঝে তোমাকে খুঁজতেন।


আমার মা, মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতাম
নীরব আশ্রয় চাইছে দেয়ালে টাঙানো তোমার ছবিটার কাছে
দুচোখের অশ্রুধারা বয়ে যেত যেন স্রোতস্বিনী নদী।
সেই মা, অসময়ে দরজায় কেউ কড়া নাড়লে
দৌড়ে ছুটে যেত তুমি আসলে বলে।
এখনো কোন বধ্যভূমি আবিষ্কারের কথা শুনলে
ছুটে যাই তৎখনাত, যদি তোমার দেখা মেলে...


জান বাবা দেশের প্রতিটি শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধকে
তোমার চিরস্থায়ী ঠিকানা বলে মেনে নিয়েছি।


আচ্ছা বাবা, সেদিন কী তুমি খুব বেশী ক্ষুব্ধ ছিলে?যেদিন এদেশের চিহ্নিত রাজাকার তোমার দেয়া পতাকা উড়িয়ে তোমাদের শ্রদ্ধার নামে অপমান করেছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধে


সেদিনই বা তুমি কেমন ছিলে? যেদিন বাংলার মাটি মানুষের প্রাণ এদেশের মহান স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবারে?
যেখানে মানুষ থাকে নিরাপদ সেই কারাগারেই কিনা
গর্জে উঠলো ঘাতকদের হাতিয়ার। কী এক বিস্ময় আর
ঘৃণা নিয়ে জাতীয় চার নেতা চলে গেলেন। আমাদের
স্বাধীনতার সূর্যটা জ্বলে থাকার শেষ শক্তিটুকু হারালো।
বাবা ফিরে আস তোমরা। সূর্যটা তোমাদের প্রতীক্ষায়
স্বমহিমায় জ্বলে উঠবে বলে...


বাবা জান কত সহজেই আমরা ভুলে যাই সবকিছু
ভুলে যেতে চাই আর সবার মতো। তোমার
সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ বেমালুম ভুলে গেল
তোমাদের শপথ আর স্বপ্নের কথা। ক্ষমতার দাপটে
দুর্নীতির জাল বিস্তার করেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়...


তুমি বেঁচে থাকলে কী করতে বাবা?  তুমিও কী
ভূঁইফোড় আমলাদের মতো ফাইল ঠেকিয়ে
টাকার কুমির হওয়ার চেষ্টা করতে? নাকি নিতে
আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি?


বাবা তুমি জাননা, সামান্য চাল ডালের হিসাবের ছুতোয়
ঐ মাথামোটাদের দল ৫৭ জন বীর সেনাদের হত্যা করলো
আহ্ কী হৃদয়বিদারক! কী ভয়ানক সেই দৃশ্য!
ঘন্টা কয়েকের জন্য সারাদেশের মানুষ যেন '৭১ এ ফিরে গেলো
গোটাদেশ বিষে নীল হয়েছিল দেশদ্রোহী হায়েনার হিংস্র ছোবলে
'৭১ এর কায়দায় লাশ ভাসিয়ে দিল ড্রেনের মধ্যে।
একটিমাত্র গর্তে পুঁতে ফেলেছিল মহান দেশপ্রেমিকদের।
কোন এক পিতা তখনো শেষ নি:শ্বাসটি আটকে রেখে মোবাইলের ক্ষীণ আলোয় টাইপ করছিল
প্রাণপ্রিয় পুত্রকে জীবনের শেষ বার্তাটি পৌঁছে দিবে বলে...


আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে বাবা
কীভাবে সামলে নিয়েছিলে নিজেকে সেদিন?


২৫ শে মার্চের দানবীয় হত্যাযজ্ঞের পর
পহেলা বৈশাখের আগেই তুমি যুদ্ধে গেলে।
সেবার তোমার কাঁধে চড়ে যে মেলায় যাবার কথা ছিলো
কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলেছিলে
এবার যুদ্ধের মেলায় যাচ্ছি বাপধন...


সেখানে যে স্বাধীনতা বিক্রি হয়
লক্ষ প্রাণের দরে তা কিনতে হয়।


স্বাধীনতা তো এল বাবা।  কিন্তু তুমি?
বিরাণ বধ্যভূমির মতো আামার কপাল আজও
স্পর্শহীন, তোমার চুমু পাবার প্রতিক্ষায়...


মেলা থেকে আমায় লাল ফিতা লাল চুড়ি এনে দেবে বলেছিলে
সেই থেকে লাল রংটাকেই আমার জীবন থেকে মুছে ফেলেছি
তুমি কী আসবেনা বাবা?


তোমার কী মনে আছে বাবা সেই ধাঁধাঁর কথা?
কোন জিনিসটা হারিয়ে ফেললে আমরা খুঁজে বেড়াই
কিন্ত পাবার পর সাথে করে নিয়ে যাইনা...
শত চেষ্টায়ও হার মেনে ছিলাম সেদিন।
তুমি হেসে বলেছিলে সে সহজ উত্তরটি: পথ, খোকা পথ।
তুমি যে আমাদের সে পথ বাবা
যা আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি আমৃত্যু।


বাবা আজ অনেক দিন পর তোমাকে কিছু সুসংবাদ
দেব বলে হাজির হয়েছি-


এইতো সেদিন বঙ্গবন্ধুর হন্থারকদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হল
তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের বিচারকার্য ও এগিয়ে চলছে
আর তোমাদের সাথে, দেশের সাথে বেঈমানি করে
যেসব রাজাকার আলবদরের দল এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে
সেসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজও থেমে নেই....


বাবা ও বাবা আমাদের আশীর্বাদ করবে না!
বাবা চেয়ে দেখ লক্ষ লক্ষ উন্মত্য অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী
জনতা বসে আছে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে
স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে
বাংলার আকাশ- বাতাস...


রাজাকারের ক্ষমা নাই, দেশদ্রোহীর ফাঁসি চাই
রাজাকারের ফাঁসি চাই, দেশদ্রোহীর ক্ষমা নাই।


বাবা ও বাবা আমাদের আশীর্বাদ করবেনা!
আমরা আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ মাটির বুকে
তাদের বিচার আমরা করবোই করবো।।
***********************************
কৃতজ্ঞতা : কবি নির্মলেন্দু গুণ