বাস্তব জীবনটা বড় বেমানান, বড় নিষ্ঠুর, বড় বিচিত্র! -- তাই না নন্দিনী ?
জীবন থেকে এক এক করে হারিয়ে যাওয়া তিরিশ-টি মরা বসন্তের পর,
আবার যে আমাদের এভাবে দেখা হবে, -- বিশ্বাস করো, আমি তা জন্মেও ভাবিনি !
কি করেই-বা ভাবি বলো ? -- ছেলেবেলার সেই পুতুল পুতুল বর,
যেদিন যুবক হুয়ে তোমাকে নিয়ে বাস্তবে বাঁধতে চেয়েছিল তাঁর স্বপ্নের খেলাঘর!
সেদিন হঠাৎ যে একটা বিধ্বংসী কালবৈশাখী এসে আছড়ে পড়বে!  -- আর তারপর....
তারপর আবার যে তিরিশ বৎসর পর, কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে তোমার সাথে আমার দেখা হবে!
শুধু কি চোখের দেখা ? -- না...নন্দিনী না...! এই তিরিশ বৎসরের জমানো যত না বলা কথা!
এক এক করে সব উগরে দিয়ে, তুমি যে আবার শুধু আমার হবে! -- একথা পাগলি, কেউ কি কখনো ভাবে ?
আচ্ছা নন্দিনী, বলতো কি করেই-বা ভাবি ? -- শেষ যেদিন কলেজে এসে, আলতো হেসে, আমায় জানিয়েছিলে,
"আমাদের সম্পর্কটা আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়!" -- আমি কি করে বুঝতাম বলো সেদিন, তোমার ওই হাসির আড়ালে লুকানো ব্যথা ?
তুমি তো পাথর সম পাষাণ হুদয় নিয়ে আমাকে  বারবার যেভাবে বলে চলেছিলে, আর প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছিলে,
বলো এরপরও আমি কি করে বুঝতাম, -- তোমার ওই ফড়িং চোখের আড়ালে করুণ আর্তনাদ ?
যেদিন বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে, তুমিই প্রথম নিষ্ঠুরের মতো বলেছিলে, -- 'এবার তোমারও একটা হিল্লে করে নিও, আমার তো হয়ে-ই গেলো!'
আমি সেদিন মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলেছিলাম, আর তোমার চোখে চোখ রেখে ভেবেছিলাম, - এই বুঝি উঠবে প্রতিবাদ!
কিন্তু তুমি  প্রতিবাদ না করে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে, আমাকে জড়িয়ে ধরে শেষ বারের মতো স্নেহ চুম্বন এঁকে দিলে !
তারপরেও আমি কি করে বুঝবো বলো নন্দিনী, তোমার ওই আনন্দ, সুখের নয়! -- ওটা শুধুমাত্র আমাকে হারানোর ভয় ছিলো!
বিয়ের রাতে তোমাকে যখন শেষ বারের মতো দেখতে গিয়েছিলাম, -- আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হল! তুমি তখনও নির্বাক ছিলে!
বলতো নন্দিনী, এরপরও আমি কি করে বুঝবো, -- তুমি তখনও শুধু আমাকেই ভালোবাসো ?  কি করে বুঝবো ওটা শুধুই তোমার সাংসারিক দো-টানা !
জানতো নন্দিনী সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল আমার, খুব ঘেন্না জন্মেছিল! -- তবে সেটা তোমার প্রতি নয়!
নিজের প্রতি! আর এই ঈশ্বরের প্রতি! -- একরকম ভেবেই নিয়েছিলাম তোমাদের ঈশ্বর হয়তো কানা!
তাই নিজেকে নিজের ঈশ্বর করে সেদিন ওখান থেকে অনেকদূরে চলে গিয়েছিলাম!
কিন্তু বিশ্বাস করো কোনোদিনও ভাবিনি যে আবার তোমার সাথে দেখা হবে, কথা হবে, আর মিলবে সেই পরিচিত আশ্রয়!
যে আশ্রয়ে মাথা রেখে একদিন মুঠো মুঠো শাশ্বত প্রেম কুড়িয়ে নিয়েছিলাম, --.যাকে নিয়ে একদিন খেলাঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম!
আজ তিরিশ বছর পর, এই বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়াল-ই এখন আমাদের সেই স্বপ্ন সাজানো করিডর!
এই নন্দিনী জানতো, আজও যখন তোমার ওই ঝিমধরা বয়সী চোখে চোখ রাখি, তখন আমি আবার যৌবন জৌলুসে জ্বলে উঠি!
মনে হয়, ফেলে আসা তিরিশটা বসন্ত যেন আমার কাছে তিরিশটা যুগের সমান! --অন্তঃপর!
এক এক করে স্মৃতির সারণি বেয়ে ভেসে আসে আমাদের ছেলেবেলায় কাটানো এক একটি সুমধুর দিনের ইতিকথা!
তারপর....! কিছুটা দহন আর বেশকিছুটা অশ্রু বিগলন করে, আমরা খুঁজে নিই শেষ সম্বল একটুকরো বাঁশের লাঠি!
হাতে হাত, পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলি বৃদ্ধাশ্রমটির দিকে, -- হাতে নিয়ে সেই তিরিশ বৎসরের পুরনো ছাতা!