ও মা জানো, -- আজ আর আমি ভালো নেই!
ভাবছিলাম তোমাকে বলবো বলবো ; -- কিন্তু কেমন যেন একটা লজ্জাবোধ হয়।
আসলে কখনো তো তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, -- " মা তুমি কেমন আছো " ?
তোমার ভালোবাসা পেতে পেতে, পাওয়ার অভ্যাসটা কেমন যেন অধিকার হয়ে গেছে।
একরকম ধরেই নিয়েছি ভালোবাসা শুধু তোমারই ভীষণ কর্তব্য, -- আমার একদমই নয়।
" মা তুমি ভালো আছো " ? -  কেমন করে ভালো থাকবে তুমি ?
আমি ভরা সংসার আর ভরা পকেট নিয়ে ভালো থাকতে পারিনা ;
আর তুমি শূন্য ঘরে, শূন্য হৃদয়ে, কর্পদক শূন্য হয়ে কেমন করে ভালো থাকবে ?
তোমার গেঁটে বাতটা কেমন আছে মা ?
সরি! তুমি বলেছিলে কয়েকবার, --  যে বাতটা তোমাকে বড় ভোগাচ্ছে।
আমি কেবলই তা ভোলার ছলে ভুলে যাই।
কেন জানি তবুও মনে হয়, তুমি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসো!
এখনো তোমার কোলে মাথা রাখলে, তুমি আমার যন্ত্রণায়,
ঠিক আগের মতোই হাত বুলিয়ে দেবে।
আচ্ছা মা তোমার ভালোবাসার ক্লান্তি নেই কেন?
আমার ভালোবাসার ক্লান্তি আছে ; -- নন্দিনীর ভালোবাসার ক্লান্তি আছে ;
শুধু তোমারটার বেলায় কেন ক্লান্তি নেই! - কেন মা কেন ?
খুব তাড়াতাড়িই তোমার কাছে আসবো। -- তুমি একটু আমার বুকে হাত বুলিয়ে দেবে।
আমি ছটফট করছি ; -- যন্ত্রণায় খুব ছটফট করছি মা।
এসেছিলাম সাত সাগর পেরিয়ে আকাশ ধরতে ;
আকাশটা আকাশেই রয়ে গেলো ; -- শুধু মাটি-টা পায়ের থেকে সরে গেলো,
মা-টা, বুকের থেকে সরে গেলো, -- মানুষজন, হৃদয় থেকে সরে গেলো।
জনারণ্য জলপাইগুঁড়ির রাস্তায়, আজকাল তোমার আঙুল খুঁজে বেড়াই ;
ভয় হয় ; -- বুঝি কোনো অজানা জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছি।
ওরা সবাই কেমন অপরিচিত!
কথা হয় কিন্তু হৃদয়ের সংযোগ হয় না।
স্পর্শ হয় কিন্তু অনুভূতি হয় না।
জানো মা,,
অভ্যাসের একটা ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা আছে ;
অমৃতও ধীরে ধীরে, কেমন যেন নোনতা হয়ে যায় !
তোমার ভালোবাসাও কেমন যেন,
প্রতিদিনকার অভ্যাস হয়ে গেছিলো।
প্রতিদিন মধু খেলে,
মধুকে আর মধু মনে হয় না।
আজ বহুদূরে সাত সাগরের পাড়ে,
তোমার স্নেহ-চ্যুত আমি ;
তোমার একটু ভালোবাসার জন্য আকুল হয়ে আছি।
হয়তো ক্ষয়িষ্ণুতার কারণে ;
নন্দিনীর মধুতেও আজকাল তৃপ্তি আসে না।
আমাদের সম্পর্কটাও কেমন যেন,
নিছকই একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
নদী আছে স্রোত নেই ;
বায়ু আছে বেগ নেই ;
জীবন আছে প্রবাহ নেই।
সবই যেন কেমন মৃয়মান !
আচ্ছা মা বলো তো,,,
জীবনে প্রবাহ কিভাবে ধরে রাখা যায় ?
মাঝে মাঝে ভাবি,
আমাদের অভ্যাসে আসক্তিই এর কারণ।  
চেনা ঘর চেনা জগতের বাইরে যেতে,
আমাদের বড় ভয়।
মানুষ জানে অভ্যাসে জীবনের মৃত্যু ;
তবুও সে অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না।
তাইতো জীবন প্রবাহ হারায়।
আর তখনই জমতে থাকে,
বিষাদ আর যন্ত্রণার শ্যাওলা।
মা আমার তো কিছুরই অভাব নেই!
তবু বুকটা কেন এতো শূন্য বলো তো ?
নন্দিনী বুকে হাত বুলিয়ে দেয় ;
কিন্তু যন্ত্রণাটা আবার ফিরে ফিরে আসে।
আমি ভালো নেই, মা।
ক্রমশ বিষাদের ছায়ায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
কেমন যেন নিজেরই পাতা যন্ত্রণা-জালে,
দিন দিন জড়িয়ে যাচ্ছি।
বাড়ি-গাড়ি ধন ঐশ্বর্য্যকে,
ভেবেছিলাম সুখের বাহক।
আজ দেখছি এগুলো সবই কেমন,
আমার যন্ত্রণার ধারক।
আজ আমার সুন্দর দাঁত আছে, হাসি নেই।
চকচকে কলেবর আছে, হৃদয় নেই।
বড় ঘর আছে, সুখ নেই।
এমন কেন হল মা ?
এখন দেখছি পরিশ্রম করলেই, সুখ আসে না।  
বড় হলেই, মহান হয় না।
আমি কি তবে, জীবনের গন্তব্যটাই হারিয়ে ফেলেছি!
এখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে,
মা তুমি বলতে, ' খোকা, জীবনে খুব হাসবি ;
তবেই সুখী হবি।
আমি আজকাল আর হাসি না।
পরি বলে - " পাপ্পা, তোমার মুখটা
সবসময় কেমন- পচা-পচা।
তুমি হাসো না কেন, পাপ্পা ?"
আমি চুপ করে থাকি,
আসলে আমি হাসতে ভুলে গেছি,
কেন জানো মা ?
আজ আমি ভালো নেই একদম ।