ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম
পথটা ঐ যে, পদ্মা-যমুনার মাঝ দিয়ে!
মানিকগঞ্জ টু নগরবাড়ির ঘাট।
মাঝ নদীতে নৌকো ডুবে গেলো,
আমি অাধুনিক ছেলে সাঁতার জানিনে
তবুও শেষ শক্তি দিয়ে লাফ দিয়ে দূরে পড়লাম।
এক সময় পানির অন্ধকারে ডুবে গেলাম
দিন না রাত বোঝা গেলো না
চব্বিশ ঘন্টা চলে গেলো,
দেখলাম আমার চোখ দুটো কাড়াকাড়ি করছে
ছায়ে ছায়ে, পাশে মা মাছ ঠাঁই দাঁড়িয়ে!


তারপর আমি ঘুমিয়ে গেলাম
মানুষ নাকি চোখে না দেখলে ভেতরের চোখ খুলে যায়!
আমার বোধ হয় তাই হলো, আমি সব দেখছিলাম।


এক সময় দেখলাম আমি ভেসে উঠেছি
ভাসতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না,
যেতেও তেল খরচ লাগছে না
আরো আনন্দ পাচ্ছিলাম স্রোতটা বাড়ির দিকে যাচ্ছিল তাই!
ভাসতে ভাসতে আমি কখন যে
আমার বাড়ির পাশের থানায় উঠে গেছি, বুঝিনে-।


দেখলাম চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে
একটা মৃতদেহ থানায় পড়ে আছে।
দলে দলে তিন দিন ধরে লোক দেখতে আসছে
কেউ চিনছে না, আমি অবাক হচ্ছি এত পরিচিত আমি!
এত পরিচিত হয়েও কেউ চিনছে না!
আসলে চিনতে পারছে না,
নাকি না চেনার ভান করছে!


আমি উঁচু বেঞ্চির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছি
সব দেখছি, বাতাস বলে যাচ্ছে
কে আসে আর কে যায়।
আমি সব দেখছি অবাক হচ্ছি কেউ চিনছে না তাই
আমার সন্দেহ বাড়ছে, রাগও বাড়ছে।


এক সময় চারপাশে পরিচিত হাওয়া ছুয়ে গেলো আমাকে
ও মা! এ কি! এতো মা আর শাওন!
লাশ রাখা ঘরের দারোয়ানকে পাঁচ টাকা গুনে দিয়ে
মা আর শাওন ঘরের ভেতরে এলো
তাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, আঁচলে মুখ শক্ত করে ধরা
চেপে রেখেছে, যদি পেটের নাড়ি বের হয়ে আসে!
আমি ঠিকই চিনতে পারছিলাম ওদের।


মা আমার মুখের উপর থেকে চাদর ঠেলে পাঁজরে নিলো,
তারপর ভালো করে দেখলো আর বললো
এ আমাদের অনিল নয়।
সে তো এতো মোটা ছিল না, তাঁর তো সব দাঁত ছিল
এঁর দুটো দাঁত নেই।
চোখ দুটো কালো ছিল, ভ্রূ ছিল গায়ের রং শ্যামলা ছিল
মিল নেই, এঁ আমাদের অনিল নয়।


শাওন কি যেন বলতে চাইলো
মা দেখলাম মুখ চেপে ধরলো, আর বললো কথা কবিনে
আজকের দুর্মূল্যর বাজারে মৃতদেহ সৎকার
সহজ নয়, কঠিন। খরচা আছে বেশ!
আমি হতাশ হলাম, ভাবলাম এত পরিচিত মানুষ আমি
যার পেটে দশমাস থাকলাম, যার পেটে নিজের
ঔরসজাত রেখে এলাম!
কেউ চিনলো না আমাকে!
কষ্ট পেলাম কিন্তু আশা ছাড়লাম না।


ওঁরা আমাকে কিছু খেতে দেয় না কিন্তু
পরদিন আমি আরো মুটে গেলাম!
আমার চারপাশ আরো ভারী হতে থাকলো
দারোয়োন আরো দূরে দাঁড়াতে থাকলো
আমি থিতু হতে থাকলাম উঁচু বেঞ্চিতে।


পরদিন অনি আর তার বোন এলো
দশ টাকা ঘুস দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে তাঁরা
আমি দেখে ঠিক চিনলাম, খুশি হলাম
তাঁরা আমাকে দেখেই চিনলো
আর বললো, এতো ওপাড়ার অনিল, অনিল দা!
আমি আশ্বস্ত হলাম।
যাক পরিচিত কেউ আমার মুখাগ্নিটা অনন্ত করবে।


অনি দারোয়ানের সাথে চুক্তি করলো আমাকে নিতে
আমি অপেক্ষায় থাকলাম
পরদিন লরিতে করে উত্তর পাড়ার শ্মশানে নেয়া হলো
তারপর দেখলাম কাঠের উপর কাঠ
আর কতগুলো ছেঁড়া টায়ার গুছিয়ে পালা করা হয়েছে
ডোম আমার পায়ে দড়ি বাঁধলো,
তারপর টেনেহেচরে নিয়ে গেলো পালার কাছে।
কাঠের পালায় শোয়ায়ে দিয়ে আগুন দিলো
আমি আগুনের লেলিহানে ডুবছি, তলিয়ে যাচ্ছি
আর দর্শকেরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।

শুধু অনি পাশে দাঁড়িয়ে আছে
আগুন যতো কমে আসছিলো,
অনির চোখের কোণের জল তত স্পষ্ট হচ্ছিল
আমি বললাম, "ধন্যবাদ তোমাকে,
আপন নও কিন্তু তুমি কতো আপন আমার
একদিন আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম আজ তুমি"।