শরীরে তার উল্কি আঁকা বেয়োনেট খোঁচা চিহ্ন,
শরীরী অমানুষ ওরা পরিচয় করেছে নিশ্চিহ্ন!
নিদারুণ কষ্টকর, শ্বাপদ পদে লুটানো জননী;
কি দারুণ নষ্ট উপহার! দাতা দুহিতা দুই রমনী।


ভূমিষ্ঠ হয়নি মরেছে মা, দেশ ভর চালু যুদ্ধ;
মৃত জননীর পেটের ভেতরে শিশু হলো সংক্ষুব্ধ!
সংযুক্ত সংক্ষোভ সংক্ষেপিত, পড়লো বেয়োনেট খোঁচা;
পেটকাটা জাতক, কন্যা শিশুর প্যাঁচানো নাড়ীর গোছা!


অসুর জারজ হানাদার, নাড়ী ছিঁড়েছে বেয়োনেটে!
নিষ্ঠুর আঘাতের দাগ আজো শিশুর পিঠ ও  পেটে!
বাংলাদেশী গায়ের রঙ, নাড়ীর টানের গন্ধ;
তেতাল্লিশ বছর পরে ও অমীমাংসিত জন্ম ধন্ধ!


ভিনদেশী পরিবারে দত্তক কন্যা বাংলাদেশী মনোয়ারা,
যুবতী বাগদত্তার প্রণয় ও যুদ্ধরূপ হলো মাতোয়ারা,
যুদ্ধশিশুর ঘরে পিতৃহীন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু!
জন্ম আজন্ম যুদ্ধের যেন পরাজিত ক্রুশবিদ্ধ যীশু।


নয় স্বাধীনতা দলিল, বিজয় গাঁথা,মুক্তির সনদ!
যুদ্ধশিশুর সামান্য চাওয়া একটি জন্ম সনদ,
নিজের শিশুর অধিকার খুঁজতে, মাতৃত্ব  সবিতা;
চোখের জলে ভিজে লেখা একরত্তি কবিতা।


------------★★★-----------
প্রেরণা সূত্র বর্ণনাঃ......
বাংলাদেশই আমার দেশ। এ দেশই আমার ঠিকানা। আমি তো এ দেশেরই কোন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি। তাই এ দেশটা তো আমারও। আবেগমথিত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন একাত্তরের যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্ক। শেকড়ের সন্ধানে বিজয়ের মাসে ছুটে এসেছেন তিনি বাংলাদেশে। কে তার মা এ তথ্য জানা নেই তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কানাডার একটি শিশুভিত্তিক সংগঠন তাকে নিয়ে যায় সেখানে। যুদ্ধশিশু হিসেবে অন্যের আশ্রয়ে বড় হয়েছেন সুদূর কানাডায়। শুধু জানেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশেরই কোন এক পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প থেকে তার মাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই মৃত মায়ের গর্ভেই তার জন্ম। বাংলাদেশের সমান বয়সী মনোয়ারা ক্লার্ক বাংলাদেশে এসে তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছেন প্রতিনিয়ত। খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার স্বজনদের। কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে এদের খুঁজে বের করার কাজটি যে কঠিন এটি তার জানা। কিন্তু হাল ছাড়ছেন না তিনি। তার বিশ্বাস নিজের শেকড়ের সন্ধান তিনি পেয়ে যাবেন। প্রাচুর্য থাকলেও প্রতিনিয়ত কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করেন তিনি। লাল সবুজের পতাকার কথা মনে হলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে তার। পাশ্চাত্য সভ্যতায় বেড়ে ওঠা তবুও মনের কোণে লালন করেন বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা। গভীর এ মমত্ববোধ থেকেই এদেশে আসা। মনোয়ারা জানান, বুঝতে শেখার পরই তিনি তার পিঠের পিছনের দিকে লম্বা একটা দাগ দেখতে পান। তিনি তার পালিত পিতা মি. ক্লার্ক ও মা হেনরি ক্লার্কের কাছে জানতে পারেন, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন নির্মমতা,পিঠের দাগ থেকে অনুমান করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহতা।একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হ্যালকি ফেরি নামে একজন কানাডিয়ান নাগরিকের সহায়তায় তার ঠাঁই হয় পুরান ঢাকার মাদার তেরেসা হোমসে। পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়ে জন্মগ্রহণ করা অনেক শিশুর ঠাঁই হয়েছিল এখানে। পরে একটি শিশু সংগঠন সেখান থেকে অনেক শিশুর সঙ্গে মনোয়ারাকেও নিয়ে যায় কানাডায়। সেখানে মিস্টার ক্লার্ক ও হেনরি ক্লার্ক নামের দম্পতির সংসারে মনোয়ারার ঠাঁই হয় দত্তক শিশু হিসেবে। ক্রমেই বড় হতে থাকেন তিনি। কিন্তু ছোটবেলায়ই তার গায়ের রঙ তাকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। দত্তক নেয়া বাবা-মার কাছে জানতে পারেন তিনি “যুদ্ধশিশু”। তার কোন আত্মপরিচয় নেই। তখন থেকেই মনোয়ারা নিজ পরিচয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ক্লার্ক ও হেনরি ক্লার্কের সংসারে তের বছর পর্যন্ত ছিলেন তিনি। মনোয়ারা, কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করে সেখানকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। প্রায় ১২ বছর আগে ফিনল্যান্ডের এক যুবকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। প্রথম সন্তান জুলিয়েটের জন্মের পরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার। এরপর থেকে জুলিয়েট মাসের পনের দিন মনোয়ারার কাছে, বাকি পনের দিন থাকে তার বাবার কাছে। জুলিয়েটের বয়স এখন দশ এবং সে ভ্যাঙ্কুভারের স্থানীয় একটি শিশু স্কুলে পড়ছে।স্কুলে পড়াকালেই বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতেন তিনি। এক পর্যায়ে ওখানে অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করা অনেক বাঙালির সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠলে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন মনোয়ারা। এছাড়া জেনেছেন ছোট্ট এ দেশটির অভ্যুদয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। স্বাধীনতার জন্য এদেশের লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে নিজের সম্ভ্রম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ফল মনোয়ারার কোন দুঃখ নেই। যুদ্ধশিশু হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না কখনও। কিন্তু কষ্ট হয় সেই নির্যাতিত মায়ের জন্য যিনি একাত্তরে তাকে পেটে ধরেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন সয়েছেন।
নিজের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য এবং নিজের বেঁচে থাকার অহংকারপূর্ণ বোধের জন্য একটি জন্ম সনদ পাওয়ার আনন্দে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে আমি আনন্দিত।