(খবরের কাগজে বেরনো একটি লেখা অবলম্বনে)


দক্ষিণ কলকাতার সূর্যনিলয় এপার্টমেন্ট
বেশ কিছু ফ্ল্যাট বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে
ধাক্কা খেয়ে ফেরে অফুরান এক প্রানের ঝলক;
" সব পাড়া তে যেও গো  টুসু, দক্ষিণ পাড়ায়
যেওনা, দক্ষিণ পাড়ায় জোড়া সতীন পান দিলে পান
খেওনা।"
যে সুর তুমুল ভাবে বেমানান আজকের এই প্ল্যাস্টিক
যুগের সাথে, এই চাকবাঁধা কংক্রিট সভ্যতা থেকে।
তবু আছে তাতে প্রান, আছে এক বেঁচে থাকার কাহিনি
আছে এক কঠিন জীবন দর্শন।
আর আছে এক মাদকতা মেশা ভালোবাসা।
ঝুমুর গান গাইছেন নমিতা মণ্ডল।
বাড়ি সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মালকেনা ঘুমটি গ্রাম
ক্যানিং এ নেমে ভটভটি চড়ে পেরতে হয়, রায়মঙ্গল নদী,
সেই সর্দার পাড়া, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আরও দুই ঘণ্টা!
সংসার বলতে স্বামী, দুই ছেলে, এক মেয়ে;
সম্পদ বলতে পনেরো বিঘা জমি, যার মধ্যে আট বিঘায়
হতো ধান, আলু কুমড়োর চাষ, পুকুর ও ছিল দুখানা;
হ্যান, সবই আজ অতীত, সবই ছিল।
আর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত কালিন্দী নদী।
যাতে জোয়ার এলে ছোট হাতজাল দিয়ে ধরত তারা
তিন চার ইঞ্চির পিন বাগদা!
তারপরে হাটে নিয়ে গিয়ে সেগুলি কে বেচা
যখন যেমন দাম পাওয়া যায় এই আর কি।
সাথে ছিল সময় পেলেই স্বামীর সাথে চাষের
কাজে হাত লাগানো, তবু দিন শেষের বেলায় ছিল
মনের আনন্দে দাওয়ায় বসে ঝুমুর গান!
তালিম বলতে ওই বনের সর্দারজীর কাছ থেকেই
শুনে শেখা সব টুকুই, বড় ভালো গাইতেন সে গান নমিতা মণ্ডল।
হঠাৎ করেই বদলে গেলো একদিন সব,
সর্বনাশী আয়লার গ্রাসের বলি হয়ে গেলো, তার সব বেঁচে থাকার
আশা, ঘর দুয়ার, নিমেষে মিশে একাকার হয়ে নদী হয়ে গেলো!
হাজার হাজার মানুষের মতো রাস্তায় উঠে এলেন তিনিও।
কিছু সরকারি সাহায্য, মাথার ওপরে পলিথিনের ছাউনি, সরকারের
কিছু চেনা প্রতিশ্রুতি, আর সাহায্য বলতে চিঁড়ে, মুড়ি, গুড় আর প্যাকেট
করা জল।
কিন্তু কতদিন চলে তাতে??
এরা রাজনীতি বোঝেন না , বোঝেন না এরা নারী দিবসের তাপ উত্তাপ;
তার ঝুমুরের ভাষায় " এসব খেলা কেই বা বোঝে বন্ধু!!"
চোখের নদীতেও আজ পুরু চড়া!!
এরা যা বোঝেন সেটা হল জীবনযুদ্ধ,যে যুদ্ধে তারা নিজেরা সবার সামনে!
স্বামী সহ্য করতে পারেননি সব হারানোর যন্ত্রণা।
বিপর্যস্ত মানসিক ভাবে,
বড় ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে তার কথায়, কোলকাতায় কোথাও
জোগাড়ের কাজ করে, নিজের টা নিজেই চালিয়ে নেয় আজ
ঘরে আছে বাকি তিনটে পেট, তাই বাকি সংসারের ভার নিয়ে
আজ তিনি নমিতা মাসি, কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে!
তবুও যায়নি সৃষ্টির নেশা!
এখনো বছরে একবার বাড়ি যাওয়ার ছুটি পান।
আর সেখানে গিয়েই গ্রামের বাকি মহিলা দের নিয়ে মঞ্চস্থ
করেন নাটক, যে নাটকের পুরোভাগেও তিনি,
বাবুদের বাড়ি কাজ করতে করতে নিজের মনেই আউরে
যান নাটকের স্ক্রিপ্ট!
আর মাঝে মধ্যেই মনে মনে গুনগুন করেন ...।
"তোদের বাড়ি বেড়াতে এলাম, বস বলে কেউ বললি না।
চিটা তামাক পানের খিলি, তাও কি তোদের জুটল না..."
নামের আগে আজও বলেন শ্রিমতি...গলা ভারি হয়ে এলো
মাস্টার দা সূর্যসেন মেট্রো স্টেশন দিয়ে ঝম ঝম করে
পেরিয়ে গেলো AC ট্রেন টা............
শ্রীমতী নমিতা মণ্ডল ওরফ নমিতা মাসি মিলিয়ে গেলেন সে আওয়াজে...