এখন বাংলা কোন মাস চলছে? চট করে মনে পড়ছে না। ঝুম বৃষ্টি তো শ্রাবণেই হয়, শ্রাবণ কি তবে পেরিয়ে গেলো? কে রাখে তার খবর! এখন তো আবার আবহাওয়ার মা-বাপ নেই; জ্যৈষ্ঠেই নেমে আসে শ্রাবণ, শ্রাবণে বৃষ্টি আছে আছে, নেই নেই। মাঝখান থেকে প্রকৃতি বেদম বেহিসাবে ভালোরকমের নাজেহাল হয়ে বৈশাখেই ফুটিয়ে দেয় কদম ফুল, আষাঢ়ে আকাশজুড়ে সাদা মেঘ; দেখে দেখে জমিনেও ফুটতে থাকে ধবধবে সাদা কাশফুল। শরৎ এমন গোলমেলে ঋতু হয়েছে যে, তার সবটুকু সুধা গ্রীষ্মে বর্ষায় হেমন্তে বিলোতে বিলোতে তার নিজের কালেই আর কিছু থাকে না। ফলতঃ অধুনা অতিশিক্ষিত পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা ইউরোপের মতো বাংলাদেশেও ঋতু তিনটে-চারটে বলে বিনা প্রতিবাদে পার পেয়ে যায়!


শরতের এই যে নিজের থেকে হারিয়ে গিয়ে তিন চারটে ঋতুতে নিজের বৈশিষ্ট্য বিলিয়ে দেওয়া, এতে কার লাভ আর কার লোকসান? জানি না। শরৎ আমার কাছে বেঁচে আছে গুরুদেবের কবিতায়, ছোটগল্পে। শরৎকে ছিনিয়ে নেবে এমন সাধ্য শহরের ভূমি ব্যবসায়ীদেরও নেই, গ্রামের হাইব্রিড চাষীদেরও নেই। শরৎ তার "অমল ধবল মেঘ", হঠাৎ ঝিরঝির বৃষ্টি, এলোমেলো উড়ো হাওয়া, নীল মেঘালয় আর কাকচক্ষু শীতল জলে আমরণ অধিষ্ঠান করে থাকবে আমার মনের মন্দিরে।


কৃষকদের হাইব্রিড ধানচাষের প্রসঙ্গে আসি। সন্ধ্যের বেশ খানিকটে পর ফিরছিলাম গ্রামের দিকে। পাকা সড়ক থেকে নেমে দুধারে ধানখেতের মাঝখান দিয়ে কাচা সড়ক; মেঠোপথের চেয়ে খানিকটা বড় এ পথ। দুপাশের ধানে বেশ ঘন নিবিড় ভাব, কোথাও ধান বেশ ঘন সবুজ, কোথাও পাতা পেকে লাল হয়ে গেছে, কোথাও শিষগুলোতে কেবল জমছে ধানের দুধ। একহাঁটু জলের তলায় ডুবে আছে ধানের গোড়া। অকস্মাৎ মোবাইলের মৃদু আলোয় একটা দৃশ্য দেখে থেমে গেলাম। কারা যেন ধান কেটে মেশিনে মাড়াই করে কাচা খড়গুলো স্তুপাকার করে রেখে গেছে। ওগুলো থেকে ধোয়া উড়ছে। ভ্যাঁপসা খড়ের থেকে উড়া এই ধোয়ার গন্ধে মনে পড়ে গেলো অনেক পুরনো কিছু দিন। শৈশব!


কাছাকাছি গিয়ে ধানের এই ধোয়া ওড়া গন্ধটা নিলাম ভালো করে। নাক দিয়ে টেনে টেনে একেবারে পেট অবধি। কী দারুণ! আহা! রবীন্দ্রনাথের গান শুনে ফাগুনে আমের বনে ঘ্রাণে কীভাবে পাগল হতে হয় শিখেছিলাম, এই ভাদ্রে কিভাবে খড়ের ভ্যাঁপসা গন্ধে আকূল হতে হয় তা কেন তিনি লিখেননি? রবীন্দ্রনাথ পুরো বাংলাকে ময়লাটে ধুলোমাখা কাগজে ধরে রাখবেন, এমন একটা চাওয়া কেন আমরা চেয়ে বসে থাকবো?


ভাবতে ভাবতে এগুতে লাগলাম। অনুসন্ধিৎসু চোখ কাটা ধানের জমিটা খুঁজছিলো। হঠাৎ পেয়ে গেলাম। জমির ধান কেটে আবার ট্রাক্টর দিয়ে চষে ফেলেছে। কী অ্যাডভান্স!!! হাইব্রিড করতে করতে এতো এগিয়েছে কৃষকরা, পাশেরই এক জমিতে নতুন চারা, আরেকটাতে ধান মোটে পাকছে, একটাতে রোপণের তরে জমি তৈরি করেছে, আবার ওটারই রাস্তার ধারটুকুতে যত্ন করে রবিশস্যের জন্য গোবর দিয়ে আলাদা করে রেখেছে! এতো পরিশ্রমী আমাদের কৃষকেরা, তবু লোকে জাপানের উদাহরণ দেয়। এখানে একটু ভালো সাপোর্ট পেলে কী না করতে পারতো কৃষকরা?


ভাবতে ভাবতে আমার কবিত্ব মাঠে মারা যাচ্ছিলো। তখনি চোখে পড়লো ম্লান একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। জলভরা বায়ুমণ্ডল, নাকি আমার চোখদুটোই কম দেখে বলে চাঁদটাকে ঝাপসা লাগছে, কিছু বুঝতে পারলাম না। আমার মনে পড়ে গেলো জীবনানন্দের "পেঁচা" কবিতার কথা... আনমনে আওড়াতে লাগলাম---


"প্রথম ফসল গেছে ঘরে,-
হেমন্তের মাঠে – মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশ – পাতা – মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা !
ধানক্ষেতে – মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা ;
ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী ,-
তবু পাই টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরের পালক ঘ’ষে - ঘ’ষে ,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে ,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
সেই পাখি;-
আজ মনে পড়ে
সেদিনো এমনি গেছে ঘরে
প্রথম ফসল;-
মাঠে- মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর,-
কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর!-
হলুদ পাতার ভিড়ে ব’সে
শিশিরের পালক ঘ’ষে ঘ’ষে ,
পাখার ছায়ায় শাখা ঢেকে ,
ঘুম আর ঘুমন্তের ছবি দেখে-দেখে,
মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জাগে একা অঘ্রানের রাতে
এই পাখি!
নদীটির শ্বাসে
সে-রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশ – পাতা – মরা ঘাস- আকাশের তারা!
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা !
ধানক্ষেতে – মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা!
ঘরে গেছে চাষা ;
ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী ,-
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের
কোনো সাধ!"


(১৪২৫, শ্রাবণ)