“জীবনের রূপ-রস-গন্ধের ছোপ ছোপ রঙছাপ থোকা-থোকা জারুল ফুল হয়ে ফুটে আছে কাউছার জাহান লিপির কবিতায়, পাতাবাহার মন নামের এই ক্যানভাসে। প্রগাঢ় অনুভূতির কবিতা লিখেন তিনি। এই বর্তমান, তাঁর মনকে যে লাঙলের বিদারী ফলা হয়ে দীর্ণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে তাঁর জীবনবীক্ষণ আর বিবেকের যৌথ সিঞ্চন ফসল বয়ে আনছে কবিতার। আহত পাখির হাহাকার তাঁর সুরে, নিরলঙ্কার শব্দেও তাই অন্যরকম একটা আবহ; আড়ষ্ট করা, গলা বোজে আসা জীবনপাঠ।”


কথাগুলো ‘পাতাবাহার মন’ কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপ থেকে নেওয়া। অধ্যাপক-কবি খালেদ উদ-দীনের এই পর্যবেক্ষণ অনেক কথার সংক্ষিপ্তসার; সুসংবদ্ধ, সুপাঠ্যও বটে। কিন্তু কবি ও গবেষক নৃপেন্দ্রলাল দাশ যেই কথাটি এই কবিতাবইয়ের লেখকের সম্বন্ধে বলেছেন, সেটাই আমার অধিকতর পছন্দ হয়েছে। বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- “কাউছার জাহান লিপির মধ্যে একটা তাকিয়ে থাকার আনন্দ রয়েছে। এই তাকিয়ে থাকার, দেখতে থাকার আনন্দটাই মানুষকে কবি বানায়, লিপিকে তা-ই কবি বানিয়েছে।”


কথা বলছি অতিসম্প্রতি প্রকাশিত কবি কাউছার জাহান লিপির প্রথম কবিতাবই ‘পাতাবাহার মন’ এর কবিতাগুলো নিয়ে। আপাত-নিতান্ত-সরল চৌষট্টি পৃষ্ঠার এই কবিতাবইয়ে প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেসব কথামালা স্থান পেয়েছে, তা কবিতা কতটা হয়েছে তার বিচার এখন হয়ত করবেন পণ্ডিত-সমালোচকরা, কালের গর্ভে কেবল নিতান্ত পাঠক; কিন্তু এই দুদল নমস্য গৌড়জনকে বাদ দিয়েও আমাদের মত চামচিকেসদৃশ পাঠকের দুটি কথা বলবার দুঃসাহস স্বেচ্ছাশিরঃপীড়াবৎ শীতরাতের আরামের ঘুম হারাম করে রাখতে পারে, তার দ্রুত নিরাময় প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টা অল্পের ওপর দিয়ে সারা গেলে বাঁচা যায়, সেজন্য নৃপেন্দ্রলাল দাশের মন্তব্যকেই গন্তব্য ধরে নিয়ে এই কবিতাবইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে “তাকিয়ে থাকার আনন্দে”র খোঁজে এদ্দণ্ডে;- প্রিয় পাঠক আশা করি কষ্টেসৃষ্টে হলেও থাকবেন এ অভিযানের শেষোব্দি।
জারুল ফুল দেখতে কেমন হয়? আর লাউফুল? আলাদা করে ভাবিনি কখনও। ডাগর ডাগর কিংবা ড্যাবড্যাব চোখে নিতান্ত মুগ্ধ হয়ে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্তের গ্রামবাংলার প্রকৃতি না দেখলে এই দুটি ফুল যে কত চমৎকার একটি উপমায় রূপ নিতে পারে, ভাবা দুঃসাধ্য। এ কবিতাবইয়ের প্রথম কবিতা ‘জারুল ফুল’ সেটাই ভাবতে বাধ্য করে আমাদের। কবি জানাচ্ছেন, বাবার মৃত্যুর পর “গ্রীষ্ম বর্ষায় ছায়ার মতো আগলে থাকা/জারুল ফুল মা আমার/শুভ্র লাউফুল হয়ে গেলো।” তারপর আবার আকুতি- “ও লাউফুল মা,/তুমি আবার জারুল ফুল হও।/ঝুমকো-ঝুমকো, থোকায়-থোকায় ফুটে থাকো/আমার বাবার আঙিনায়।” কতটা চমৎকার তবে এ জারুল ফুল? কতটা দেখলে তবে তাকে এতটা গভীরদৃষ্টিতে দেখা হয়? এরই নাম কি তবে ‘তাকিয়ে থাকার আনন্দ’?
গভীরভাবে তাকিয়ে থাকার পাশাপাশি এ কবিতাবইয়ে খুব বেশি আরেকটা জিনিস চোখে পড়বে যেকোনও পাঠকের, সেটা কবির নিরন্তর আকুতি। প্রেমের, অপেক্ষার, বিষণ্নতার প্রতিটা মুহূর্তে কিছু একটার; এবং প্রধানত কবিতার। একজন কবির কাছে কবিতার অধিক অন্য কিছুর আকুতি থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না, এই কবিও সেটা অদৃশ্য অমিত্রাক্ষরে অসংখ্যবার লিখে গেছেন সমগ্র গ্রন্থটি জুড়ে; কবিতা এবং কবিতাবিহীন অসংখ্য কবিতা পাঠ করে কেবল বিষয়টা অনুধাবনের অপেক্ষা, আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে।
কিন্তু চোখ খুলে গভীর দৃষ্টিতে দেখবার যে আনন্দ এই কবিতাবইয়ে খুঁজে দেখবার প্রত্যয়ে আমরা নেমেছিলাম, সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেবার বোকামি না করে ব্যবচ্ছেদ করা যাক পরের কবিতাগুলো। পড়া যাক ‘ব্যবচ্ছেদ’ কবিতাটাই, “ইথারে ভেসে আসে অচল মুদ্রা/ফেলে দেওয়া কিছু স্বপ্ন!/ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনিতে... ...নামে বিষাদের ছায়া... ...জীবন!/একা, তবু একা না।”


অতঃপর ‘দৃশ্যপট’ কবিতাটিকে এই মর্মে সেরা কবিতা বলা যায়-
“দৃশ্যপট প্রাচীন, মুখভারী বর্ষা দাঁড়িয়ে আছে, একপায়ে; শিকারি বক-
যেন। একটি মাছরাঙা-মৃত্যু ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো সঙ্গিনীর রাতের আহার!
সন্ধ্যার গাঁয়ে ক্লান্তি মেখে নগরের বাউল ফিরে আসে রোজকার নিকষ-
কালো অন্ধকার জীবনের। অপেক্ষায় নেই প্রিয়ার উদাসী কাজলনয়ন!”


কিংবা কবির সাথে বসে যদি আমরা ‘দোয়েলের বৃষ্টিস্নান’ দেখি, কত প্রকারের বৃষ্টি যে ঝরতে পারে এক বর্ষায়, তার খানিক আনন্দ তো নিজের মধ্যেও সঞ্চারিত করা যায় তাহলে। কবি জানাচ্ছেন- “কম করে হলেও দিন সাতেক/চাতক বারি, জম জম বারি, ঝুম ঝুম বারি, ঝির ঝির বারি/শেষ নাগাদ আপদ বারি! থামে না কেন?... ...অলসভাবে বসে আছি বারান্দায়/বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতাগুলো কাঁপছে তিরতির করে প্রেয়সীর ছোঁয়ায়!/হঠাৎ দু’টো দোয়েল কিচিরমিচির/করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ ডাল থেকে ঐ ডালে।/তাদের ঝগড়া দেখে মনে পড়লো/বিশ বাইশ বছর আগের কথা/এমন তো আমরাও ছিলাম/সময়টা...”
নারীরা যে গল্প বুনতে কত ভালো জানেন, তার ভুরিভুরি প্রমাণ তো আমরা সবসময়ই পেয়ে এসেছি, কিন্তু নারী কবিদের মধ্যে যখন গল্প বোনার এই সহজাত প্রতিভার সাথে কবিতার বাসনা যুক্ত হয়, তখন কবে যে বৃষ্টির ফোঁটা ‘প্রেয়সীর ছোঁয়া’ হয়ে যায়, গাছের পাতাদের জন্য; আর দুচোখ খুলে দেখবার আনন্দ নিয়ে কবি দেখেন- ‘পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে’, তখন বিষয়টা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের একটা চিত্রকল্পে রূপ নেয়। লোভ জাগে, আমি তা দেখি না কেন, এই কবি যা দেখতে পাচ্ছেন?
না দেখতে পাওয়ার হয়ত একটা কারণ, আমার “দুঃখগুলো আগুনে পুড়ে বিন্নিধানের খৈ এর মতো” ফুটে ফুটে আঙিনা ভরিয়ে তুলে না। কবির দুঃখগুলোর মতো আমার দুঃখরা না “সৌরভ ছড়ায়, হাসে- জুঁইফুলের মাদকতায়”, না আমি বলতে পারি “কোনো কিছুই পর নয়/না দুঃখ, না সুখ।” আমাদের তাই কবির প্রতি, কবিতার প্রতি মুগ্ধতা চিরকালিন, জন্মের পর থেকে আমরা কবিতা শুনি। মায়েদের মুখ থেকে, প্রেমিকাদের মুখ থেকে, কবিদের মুখ থেকে। জীবনকে আলাদাভাবে দেখতে শেখান তারা, আমরাও শেখবার কোনও ইচ্ছে ছাড়াই নিয়মিত শিখি, নইলে তো টেক্সটবুক আর কবিতাবইয়ে মুগ্ধতার এত পার্থক্য থাকত না।


দেখবার আনন্দের কথা হচ্ছিল। কিন্তু যে কবি “প্রগাঢ় অনুভূতির কবিতা লেখেন” বলে ফ্ল্যাপেই জানিয়ে রেখেছেন কবি খালেদ উদ-দীন, তার অনর্গল স্বাক্ষর প্রতিটা কবিতায়, অসংখ্যবার দর্শনের পরও চোখ বোজে কেবলই ‘দেখবার আনন্দ কোথায়’ সেটা খুঁজতে থাকার মানে হয় না। আমরা যেহেতু পণ্ডিত না, এবং ‘পাতাবাহার মন’ এর স্বার্থকতা বিচার আমাদের কর্ম নয়, সেটা বরং বিদ্বজ্জনের অপেক্ষায় রেখে আমরা খুঁজতে বসেছি কীভাবে মুগ্ধপাঠের সন্দর্ভ জানিয়ে এই পাঠানুভূতি প্রকাশের যবনিকা টানা যায়, অতএব খুব বেশি চোখে পড়ে যেই ‘প্রগাঢ় অনুভূতি’, তার খবর নিতে সরাসরি চলে যাওয়া যাক।

“গেছো শামুকের গতি নিয়ে
বুকের প্রাচীরে উঠানামা আর ব্যথাহত অনুভব।
... আমার বুকে ক্রমশ পাললিক
স্বপ্নগুলো রঙচটা
ইটের আড়ালে অসহায় দূর্বাঘাস!”
                                           (সহজিয়া এবং)

“দ্বিপ্রহরের জোছনায়
তোমার লেখা চিঠিগুলো উল্টে-পাল্টে দেখি
চেনা তোমার গন্ধ নিই-
তোমার সেই উষ্ণতার ছোঁয়া নিই
খুলে পড়ি না কী লেখা অক্ষরে-অক্ষরে
... জানি-
এখানে কোনো ভালোবাসার কথা নেই,
এখানে কোনো প্রেম নেই,
এখানে কোনো পদ্ম নেই,
নেই এতোটুকু প্রণয়ের কোমল চিহ্ন”
                                           (চিঠি কাহিনি)

“আবার বেখেয়ালে তোমার
দরজায় কড়া নাড়ি।
পথ ভুলে, নাকি মনের ভুলে
পা দুটো এখানেই এসে থামে।
আসলে আমার ঠিকানা তো তুমি,
একবার নয়, বার বার বলেছি।
পাতাবাহার মন তোমার।”
                                            (পাতাবাহার মন)


গ্রন্থভূক্ত প্রত্যেকটা কবিতাই যেখানে অনুভূতির স্পর্শসিক্ত, সেখানে কি খুব বেশি কবিতার সংখ্যা ‘অনুভূতির কবিতা’ বলে আলাদা করার আর প্রয়োজন আছে? এই অনুভূতিও অনির্ধারিতসংখ্যক সময়-বিষয়-পাত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বইটি প্রকাশ করেছে লালশির গ্রন্থালয়। চমৎকার প্রচ্ছদ আর সংহত বোর্ড বাঁধাইয়ের এই বইটির দাম রাখা হয়েছে ২০০ টাকা, যেটা খানিকটা বেশি বলেই আমার মনে হয়েছে। সর্বোপরি একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এই কবির কবিতাচর্চার আমৃত্যু আয়ূ কামনা করি, তিনি যেন কখনই কবিতাচর্চা বন্ধ না করেন, যেন তাঁর দেখবার দৃষ্টি অবিরত দৃষ্ট্য-অদৃষ্ট্যের গভীর থেকে নিত্য তুলে আনে সুগভীর কথামালা, চাই সে পদ্য হোক বা গদ্য, কিন্তু সে যেন অনিত্য না হয়ে যায়, যেন বঞ্চিত না করে আমরা আগ্রহী পাঠককূলকে।