১৭৮৫। লেবেদেফ পা রাখলেন মাদ্রাজ-এর পুর্ব-উপকুলের এক বন্দরে। কয়েক বছর পর তিনি পাড়ি জমালেন বাংলার উদ্দেশ্যে। আসলেন কলিকাতায়।


কলিকাতায় বাঙ্গালী শিক্ষক গোলোক নাথ দাশ-এর সহযোগীতায় বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা চর্চ্চা করলেন। শুধু নিলেনই না, দিলেনও। তাঁর বাঙ্গালী শিক্ষক-কে তিনি বেহালা-বাদন ও ইউরোপীয়ান সংগীত-এ দীক্ষিত করলেন। লেবেদেফ বাংলায় অনুবাদ করলেন M.Jodrelle-এর The Disguise এবং Moliere-এর L’Amour Medecin। প্রথম অনুবাদটির নাট্যরূপ, নাম দিয়েছিলেন ‘কাল্পনিক সংবদল’–তার কয়েকটি অংশ পরিবেশিত হল ডোমতলা (অধুণা এজরা স্ট্রিট)-এ অবস্থিত ‘নিউ থিয়েটার’ (মতান্তরে ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’) মঞ্চে। আমাদের প্রথম বাংলা থিয়েটার-দর্শন। দিনটা ছিলো ২৭ নভেম্বর ১৭৯৫। ২০০ সিট হাউসফুল!! সেদিন অভিনয় করেছিলেন ১০ জন অভিনেতা ও ৩ জন অভিনেত্রী। পরবর্তী নাট্যস্থাপনা ২১ মার্চ ১৭৯৬। তারপর ইতিহাস................। লেবেদেফ-এর আদর্শে অণুপ্রানিত হয়ে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ১৮৩১:হিন্দু থিয়েটার, ১৮৫৩:ওরিয়েন্টাল থিয়েটার, ১৮৫৭:বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (কালী প্রসন্ন সিংহ), ১৮৬৫:জোড়াসাঁকো নাট্যশালা১  (প্যারিমোহন বসু) ও জোড়াসাঁকো নাট্যশালা২ (গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ১৮৬৫:পুর্ববঙ্গ রঙ্গভুমি (মোহিনী মোহন দাশ), ১৮৬৮: বঙ্গ নাট্যালয়১ (যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর) ও বঙ্গ নাট্যালয়২ (বলদেব ধর), ১৮৮৭:এমারেল্ড থিয়েটার (গোপাললাল শীল), ১৮৯০-৯২:ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ, ১৮৯৭:ডায়মণ্ড জুবিলী থিয়েটার (কিশোরি লাল রায়চৌধুরী)। এছাড়া  এই সময় জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ নামে এক থিয়েটার-দল তো এখনও বিদ্যমান। এবাদে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার তো (অমৃতলাল বসু/গিরিশ ঘোষ ধন্য) সর্বজনবিদিত।


পাঠকবর্গ, বাংলা সংস্কৃতির এই লেজ টেনে আনবার একটাই উদ্দেশ্য – আমরা চিরকাল গঙ্গার পুন্যপ্রবাহে অবগাহন করেই গেলাম, গোমুখের খোঁজ করলাম না।


সেই যুগে লেবেদেফ আয়োজিত সংগীত-জলসা শুনতে হলে কড়কড়ে ১২/- গলে যেত। লেবেদেফ-এর এই সাফল্য বুকে আগুন ধরাল ইংরেজদের। তাদের দুই প্রতিনিধি সত্যি সত্যি আগুন লাগাল লেবেদেফ-এর থিয়েটারে। তাঁর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
  
দমলেন না তিনি। রাশিয়ান জার-এর অর্থসাহায্যে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি প্রেস ‘ইম্প্রিমের ইন্ডিয়েনে’, শুধুমাত্র বাংলা বই ছাপার জন্য। প্রকাশ করলেন ছোট অভিধান (১৮০১), গণিত শাস্ত্রের বই লিখলেন, ভারতচন্দ্রের ‘আনন্দ মঙ্গল’-এর একাংশ অনুবাদই করলেন না রুশ ভাষায়, লন্ডন-এ থাকা রুশ রাজদুত-কে পত্র দিলেন- ভারতচন্দ্রের ‘আনন্দ মঙ্গল’ কে পাদপ্রদীপের আলোয় আনবার জন্য।


স্বাভাবিক ভাবেই(!) লেবেদেফ-এর ভারতপ্রেমে রুষ্ট হলেন ব্রিটিশ সরকার। ১৭৯৭ সাল। সরকার দ্বারা আদেশবলে ভারত থেকে বিতারিত হলেন লেবেদেফ। বাংলার স্বার্থে লেবেদেফ তখন প্রায় নিঃস্ব। শেষ পুঁজি ২৯৫/- টাকা সম্বল করে ভারত ছাড়লেন লেবেদেফ। বছর চারেক কেপটাউন-এ কাটিয়ে ১৮০১ সালে ফিরে গেলেন দেশে।  


লেবেদেফ পরে ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন। লাভ করেন কোর্ট কাউন্সিলর পদ ও রাশিয়ান ফরেন কলেজের অনুবাদকের পদটিও। তাঁর কলমও থেমে রইল না। তিনি লিখলেন – ১৮০১(লন্ডন) সালে ‘এ গ্রামার অব দি পিওর অ্যান্ড মিক্সড ইস্ট ইন্ডিয়ান ডায়ালেক্ট’, ১৮০৫ (সেন্ট পিটারসবার্গ) সালে ‘অ্যান ইম্পারশিয়াল কন্টেমপ্লেশন অব দি ইস্ট ইন্ডিয়ান সিস্তেম অব ব্রাম্ভিন্স’, ‘এ কালেকশন অব হিন্দুস্তানি অ্যান্ড বেঙ্গালী আযর্স’..... আরও..... আরও..... আরও.....


সালটা ছিল ১৮১৭। দিনটা ছিল ১৫ জুলাই। চলে গেলেন লেবেদেফ গেরাসিম স্তেপানোভিচ। সমাহিত করা হল মস্কো-র লেনিনগ্রাদে।


কমরেড লেবেদেফ, তুমি ছিলে, তাই বঙ্গসংস্কৃতি ছিল, আছে, থাকবে।