যাইহোক, আজকের বইমেলা উপলক্ষ্যে কিছু বই উপহার পেলাম। বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কবির সাক্ষর, তারিখসহ। যেমন ১) কবি অজিতেশ নাগকে ভালোবাসায় – কবীর হুমায়ূন, ২) অজিতেশ নাগকে ভালোবাসার স্মারক - কবীর হুমায়ূন, ৩) বাংলা কবিতা ডট কমের আমাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি – প্রিয় কবি অজিতেশ নাগকে শুভেচ্ছা, অমর ২১শে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে রাত ১০টা – সরকার মুনীর। বুঝে দেখুন রাত দশটা! ওরা তখনো আমাদের সঙ্গে। এরপর তো আর আটকে রাখলে চলে না। অবশেষে বিদায় বন্ধুগন, আজকের জন্য। কালকের প্রোগ্রাম রেডি হয়ে গেল ধূমপান করতে করতেই। এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, আজকের এই মিলনমেলায় মাসুমভাই কিন্তু এসেছিলেন ভয়ানক অসুস্থ শরীরে। একগুচ্ছ ওষুধ গলার্ধকরন করে উপস্থিত হয়েছিলেন শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গ দেবার জন্যেই। আর শুধু আজকে নয় আমাদের চলে যাবার দিনও কয়েক লাখ টাকার প্রজেক্ট নিয়ে এক বিদেশী ক্লায়েন্টের সাথে মাসুমভাইএর জরুরী মিটিং ছিল। সেই সব মুলতুবী রেখে তিনি চলে এসেছিলেন বিমানবন্দরে! আমাদের যে ভাবনার অতীত এইসব মানুষগুলো! মাসুমভাইএর এই মাসুমিয়ত যেন আপামর বাংলাদেশের প্রতিভূ। হৃদয়ের কাছে শরীরটা যেন কিছুই নয় এই মানুষগুলোর কাছে। যাইহোক, কাল দেখব পদ্মা। ছোটবেলা থেকে ভুপেন হাজারিকার কন্ঠে কতবার শুনে আসছি – গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা। এক মা’কে দেখেছি, আরেক মা’কে দেখব না! তাই কখনও হয়? অতএব কালকে সকাল সকাল গাড়ি ভিড়বে রমনার সামনে, একেবারে যাকে বলে সক্কাল সক্কাল। তাই আর দেরী নয়, একটা CNG নিয়ে সোজা হোটেল। ফিরতে না ফিরতেই বুলবুলসাহেবের ফোন। তাঁর সাথে যে সামান্য কথাটুকু হল, হোটেলের ক্যান্টিনে তার চাইতেও অতি সামান্য কিছু খেয়েই সোজা ঘরে। হোটেলের ক্যান্টিনের কথাই যখন উঠল তখন একজনের উল্লেখ না করলে এ লেখা অসমাপ্তই থেকে যায়। আরমান। আরমান ছেলেটির কথা না বললেই নয়। এই ছেলেটি আগুন নদীর পরিচিত, রমনা হোটেলে ক্যান্টিনের দ্বায়িত্বে। একদম গোড়া থেকেই রোজ আমাদের খোঁজ নিয়েছে হোটেলের ঘরে এসে কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে নিরন্তর। এমনও হয়েছে, আমাদের ফিরতে রাত হল, এদিকে ক্যান্টিন বন্ধ। আরমান নিজে অন্য কোন জায়গা থেকে, একবার তো নিজের ভাগ থেকে ভাত এনে দিয়েছে আমাদের। এসব ভুলব কিভাবে? রোজ সকাল, রাতে এসে ‘দাদা, কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ চিরদিন মনে থাকবে। মনে থাকবে আরমানের ‘ইটস ওকে’ / ‘নো প্রবলেম’ শব্দাবলীও। কলকাতায় চলে আসার পরেও সুমিতার হোয়াটস অ্যাপে ভয়েজ মেসেজ পাঠিয়ে ছিল। যেটা বারবার শুনতে ইচ্ছা করে। তার মধ্যে কিছু বাক্য এখন মনে আসছে – ‘দাদা, দিদি ক্যামন আছেন? আপনাদের জন্য ভী-ষ-ণ মন কেমন করতাছে। জানি না কেন, তবে আপনাদের খুব মিস করতাছি। নিশ্চয়ই আগের জন্মে আপনাদের সঙ্গে আমার কোন রিলেশন আছিল। আমার তো আর ভাগ্য নাই, কুনদিন সুযোগ পাইলে যামু আপনাগো দ্যাশে। ভাল থাকবেন, আমার মিষ্টি বোনটি কেমন আছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের রমনা হোটেলে তো শেষদিনে প্রাতরাশের পয়সাই নিল না। কথা দিয়েছে চলে যাবার দিন সুমিতাকে শুঁটকি মাছ এনে দেবে।


যাই হোক যা বলছিলাম, খেয়ে এসেই লেগে গেলাম গোছগাছ করতে। এই হোটেলের মেয়াদ আমাদের ফুরালো। কালই আমাদের একপ্রকার কিডন্যাপ করে তুলে নিয়ে যাবে বৈদ্যবাবু। আর হোটেলে থাকতে দিতে চান না তিনি। তার মতে অযথা হোটেলের পয়সা গুনছি আমরা, তাছাড়া ওনার বাড়ি থেকে বিমানবন্দর কাছেই। ফেরার সময় জ্যামের ঝামেলা পোহাতে হবে না। আমরাও ভেবে দেখলাম সইত্য কথা। তাই অগত্যা। বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। এখন অবধি যেটুকু ঠিক আছে, কাল সকালে ঘুরতে বেড়িয়ে দুপুর নাগাদ ফিরে আসব রমনায়। তারপর সোজা উত্তরার পথে। অতএব বিদায় রমনা।  
        
আজ সেই ঐতিহাসিক দিন। ২১.০২.২০১৫ (শনিবার)। অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।  শুধু বাংলা ভাষার সম্মান রাখার জন্য যে বা যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণ করার দিন। রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব-পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকে যে সংগ্রাম শুরু করে তা বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল ১৯৫২এর ২১শে ফেব্রুয়ারী। তবে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালী জনগোষ্ঠীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ৫টি বছর । ১৯৫৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সংবিধান উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান জানাতে বাধ্য হয়। তাই এই মাস, এই দিন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দিন, আবুল বরকত, রফিক উদ্দীন এবং আব্দুল জব্বারদের অমর করে রাখার দিন। তাই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমি দাঁড়ালাম এসে ৯তলার বারান্দায়। তার আগের রাত্রেই অবশ্য টেলিভিশনে দেখছিলাম শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রনায়ক, নেত্রীদের। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীও। যাই হোক, ওপর থেকে দেখলাম কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে বেগবান নদীর মত, লক্ষ্য স্থির অথচ অচঞ্চল।  আর হবে নাই বা কেন?  ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করে এরূপ আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। মানুষ আসছে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, মুখে তাদের গান -  একুশের প্রথম গান -   “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী”, ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পরও যে গানটা শুনলে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে প্রতিটি বাঙ্গালীর। আমি জানতাম গানটি লিখেছিলেন (প্রথমে কবিতার আকারে) আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমার খুব জানা ইচ্ছে ছিল এই গানটি প্রথম কে গেয়েছিলেন? কোথাও পড়লাম লতিফ আতিকুল ইসলাম আবার কোথাও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাষা সৈনিক আলতাফ মাহমুদ। তবে জানলাম, এই গানটির ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন কবির চৌধুরি।  


কিন্তু আমি ভাবি এক, মহান ঈশ্বর আরেকদিকে অঙ্গুলিপাত করলেন। আমার মেয়ের কিছুতেই ঘুম ভাঙল না। এইদিনে কেউ ঘুমায়! কিন্তু তাকে বোঝায় কার সাধ্য। আর এদিকে আমার স্ত্রী স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে মহানন্দে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। অতএব রয়ে গেলাম আমি – বারান্দায়। একেবারে যাকে বলে হা হতোস্মি অবস্থা! একবার ঘর আরেকবার বার করছি। কি করি কি করি ভাব। অতএব স্নানটা সেরে রাখলাম। তারপর হোটেলের নিচে একবার ঘুরে এলাম। একটা ডার্বি সিগারেটও ধ্বংস করা গেল। ৯তলার ওপর থেকে নিচের নাগরিক চলমান জীবনের সাথে একাত্ব হতে থাকলাম বেশ কিছুক্ষন। তখনো মেয়ের ঘুম ভাঙ্গেনি। অবশ্য বেশীক্ষন তার সুখস্বপ্ন স্থায়ী হল না। হইহই করে এসে পড়লেন আমার স্ত্রী, হাতে শহীদমিনারের উল্কি আঁকিয়ে, সাথে ফজরের নমাজ শেষে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসা শ্বেত শুভ্র বসনে হুমায়ূনবাবু। এবার ঘুম ভাঙ্গতে বাধ্য। হুমায়ূনবাবু একাই এলেন না, সাথে আনলেন মাসুমভাইকেও। উঠল হাসির হুল্লোড়। হুমায়ূন ভাইয়ের এক মহিলা ভক্তকে নিয়ে রসালোচনা চলল বেশ কিছুক্ষন। মাসুমভাইয়ের হাতে সুমিতা ধরিয়ে দিল বেশ কিছু হজমীগুলির শিশি। এবার তার দায়িত্ব সেগুলোকে বাকি কবিদের মধ্যে বিতরণ করা। কি মুস্কিল! তবে আর দেরী নয়। মেয়েকে রেডি করিয়েই সোজা ক্যান্টিনে। সকালের নাস্তা হল। এবার বেড়িয়ে পড়ার পালা। আরমান ছেলেটি যথারীতি শুঁটকি মাছের দুটো বিশাল প্যাকেট এনে হাজির। কিন্তু দাম? আমি চেষ্টার অতিরিক্ত করেও তার হাতে একটা টাকাও ধরাতে পারলাম না। এমন মানুষও হয়!


কিন্তু গাড়ি (সৌজন্যে সেই বৈদ্যবাবু) ছাড়তে পারছে না। কারন মুনীর ভাই। তিনি তখনো এসে পৌঁছতে পারেন নি। ফোন দিলেই বলে – ‘এই তো এসে গেছি’। প্রায় আধঘণ্টা পেরিয়ে তিনি ‘এসে না যাওয়াতে’ আমরাই বেরিয়ে পড়লাম দুগ্গা দুগ্গা বলে। মুনীর ভাইকে তুলে নেওয়া হল রাস্তা থেকেই। বেচারা তাড়াহুড়াতে কিছু না খেয়েই চলে এসেছে। ঠিক হল রাস্তাতেই নাস্তা! এবার সোজা পদ্মাপাড়। শহীদ বেদীর জন্য মন খচখচ করছিল। যাক গে, প্রায় সবারই ঘুড়ে আসা হয়েছে, আমার জন্য আলাদা করে এখন কে আর সঙ্গে যাবে? ঠিক আছে, বিকেলের দিকে যাব, তবে যাবই।