আজ ২২.০২.২০১৫ (রবিবার)। সকালে উঠেই সাজ সাজ রব, আজ যেতে হবে মাসুমভাইয়ের ঠেকে। মানে ওনার অফিসে। বনানী এলাকাটা রাতে দেখেছিলাম, আজ সকালের আলোয় দেখলাম। বেশ সুন্দর গোছানো রাস্তার দুধারের সুদৃশ্যের সাথে মানানসই ভালো ভালো বাড়ি ঘরের কাঠামো বিশিষ্ট মডেল টাউন এই বনানি। নিচে এসে দুইতলায় সাজানো অফিসে সাদরে নিয়ে গেলেন মাসুমভাই। আলাপ হল ওনার ছোট মেয়ের সাথে। কণা। ভারি মিষ্টি মেয়ে। আব্বার মতই সদাহাস্য মুখ। নম্রভাষী। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গেলো। এরপর মাসুমভাই আর ওনার মেয়েকে সাথী করে চললাম কিছু শপিং করতে। আসলে কোথাও গেলে সবার জন্যই কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসার বাসনা জাগে। কিন্তু সবার জন্য কিনতে গেলে পকেটে রেস্ত-এ টান পড়বে নির্ঘাৎ। যাই হোক, সামান্য টুকিটাকি ক’টি শপিং সেরে ফেললাম আর একফাঁকে আবারও খানিকটা ভারতীয় টাকা বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করে নেওয়া গেল। কারন ইতিমধ্যে বাংলাদেশী টাকার স্টক নিঃশেষিত। যদিও এদেশে পা দেওয়া ইস্তক খরচা করতেই দিচ্ছেন না কেউ। যেটুকু খরচা করছি নিতান্তই জোরজার করে।


মাসুমভাইদের কাছ থেকে জবরদস্তি বিদায় নিতে হল, নাহলে দুপুরের খাবার খাইয়েই ছাড়ত। ওদিকে আমাদের হিসেবে রবিবার ছুটির দিন হিসেবে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে আজ একটা ভরপুর কাজের দিন। তবুও প্রিয়া অনেক রকমের পদ রেঁধে অফিস চলে গিয়েছিল। আর আমাদের দেখভালের জন্যে রেখে গিয়েছিল শ্রী’কে। এই অবসরে বলি শ্রীর কথা। পুরো নাম শ্রীদেবী। বৈদ্যবাবুর খুড়তুতো বোন। হাসি মুখের এই মিষ্টি মেয়্বেটি আমাদের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছিল বরাবর। এইখানে আরও কিছু মানুষের কথা বলে নিই। কারন কাল চলে যাবো। পরে ভুলে যেতে পারি (যদিও তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে)। শ্রী’র কথা বললাম। এবার বৈদ্যবাবুর ছেলে স্পন্দন। আগেই লিখেছিলাম ভারি গম্ভীর স্বভাবের লাজুক ছেলেটি। ভীষণই কম কথা বলে, তবে শপিং-এ দারুণ অভিজ্ঞতা, যেটা বিকেলে বেরিয়েই টের পেয়েছি। ভাগ্যিস স্পন্দন ছিল, না হলে জ্যামের সন্ধ্যেতে আমরা হারিয়েই যাচ্ছিলাম। শুধু তাই নয়, জিনিষপত্র কেনার ব্যাপারেও দারুণ মুল্যবান মতামত দিয়ে থাকে। তৃতীয় জন বৈদ্যবাবুর ড্রাইভার কামাল। কালোকুলো ছেলেটি মিষ্টভাষী। ভারি অদ্ভুত মানুষ, ভীষণ বিনয়ী। কোনভাবেই আমাদের যাতে চলার পথে কোন অসুবিধা না হয়, সেই ব্যাপারে সদাসতর্ক ছিল। শেষে বলি প্রিয়া’র কথা। বৈদ্যবাবুর স্ত্রী। সদা হাস্যময়ী। তবে ওনাকে দেখলেই আতংক জাগে। হাঃ হাঃ হাঃ। পাঠককুল শংকিত হবেন না। মজা করে বললাম। আসলে আদ্যান্ত ভালোমানুষ এই মেয়েটি খাওয়াতে খুব ভালবাসে। মুরগী, পাঁঠা, ইলিশ, কাঁকড়া ..... কত রকমের যে খাদ্যসম্ভার বৈদ্যবাবুদের ফ্রিজারে সংরক্ষিত আছে, এদের আতিথ্যগ্রহণ না করলে বিশ্বাসই হবে না।


বিকেলে আবার শুরু হল শপিং। মানে ফিনিশিং টাচ দেবার এটাই শেষ প্রচেষ্টা। কালই তো দেশে ফেরার বিমান ধরতে হবে। এবার ৩টে রিক্সা। একটায় প্রিয়া আর সুমিতা, আরেকটা ঈশানী আর শ্রীদেবী, শেষেরটাই স্পন্দন আর আমি। শুধু রিক্সা চাপলেই তো হয় না, রিক্সা থেকে নামতে হয়, শপিং করতে হয়, আবার রিক্সা চড়তে হয়। এই ওঠা নামা করতে করতেই কোমরে টনটন বেদনার অনুভুতি। পাল্লা দিয়ে হাতের কব্জি ঝনঝন। মাথাও বনবন করতে যাচ্ছে এমন সময় আমাদের রিক্সা অন্যদের হারিয়ে ফেলল, অথবা আমরাই হারিয়ে গেলাম। যাই হোক অনেক কসরৎ করে আবার খুঁজে পাওয়া গেলো। শপিং করা হল আরং প্লাজা, লন্ডন প্লাজা, তাঁতঘর, ১-টু-৯৯ এই সব দোকানে। শেষের দোকানের নামটাই বলে দিচ্ছে সবকিছু। এই দোকানে সব জিনিষের দামই ১ টাকা থেকে ৯৯ টাকা অবধি। মোটামুটি যার যার নাম মনে এলো সবার জন্যেই কিছু কিছু নেওয়া গেলো, যাকে বলে টোকেন গিফট।


তবে একটা জিনিষ খুব খারাপ করেছি। ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম কবীরভাইকে সময় দিয়েছিলাম। উনি হয়ত আমাদের জন্য কোথাও অপেক্ষা করছিলেন, আমরাই দেখা করতে পারিনি। ব্যাপারটা মনে পড়ল ক্লান্ত দেহ টানতে টানতে তার উপর ৬তলা ভেঙে বৈদ্যবাবুর ফ্ল্যাটে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে। আন্তরিক দুঃখিত হুমায়ূন ভাই। কথা রাখতে পারিনি।


বাংলাদেশে আমাদের আজই শেষ রজনী। দেখা হল না অনেক কিছুই। দেখা হল না ৩২, ধানমণ্ডির পুণ্যস্থান, দেখা হল না ফরিদপুর, অদেখা রয়ে গেল কক্সবাজারের সৈকত। কিছুটা মন খারাপ ঘিরে ধরতেই ফোন দিল শিমুল শুভ্র। কথা হল রুম্পা শিমুলের সাথেই। ওদের বাড়িতে এ যাত্রায় আতিথ্যগ্রহণ করতে পারলাম না বলে ওরা যারপরনাই দুঃখিত হল। কথা দিলাম আবার আসলে নিশ্চয়ই যাব আমার রুম্পা বোনের বাড়িতে। ততদিন ওরা ভাল থাকুক, ভাল থাকুক ওদের একমাত্র সন্তান। এ যাত্রায় শুধু শিমুল শুভ্রের পরিবার নয়, প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও চাক্ষুস সাক্ষাৎ হল না আনিছুর রহমান, সাবলীল মনির দের সঙ্গে অথবা যোগাযোগ করে উঠতে পারলাম না পলক রহমান, রহুল আমীন হৃদয়, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, হাফিজুর রহমান চৌধুরী দের সঙ্গে। আর অধরাই থেকে গেলেন কবি হাসান ইমতি। ইমতিতাজ ভাই যে কোন নীলিমায় হারালেন! তবে আশা রাখি, যাদের পেলাম অথবা পেলাম না, সবার সঙ্গেই দেখা হবে বন্ধু, আবার কোনদিন, অন্য কোনদিন, অন্য কোথাও অথবা এইখানে দুই বাংলার কোন এক যাপিত হৃদয়াঙ্গনে।


আজ ২৩.০২.২০১৫ (সোমবার)। বাংলাদেশে আজ আমাদের এবারকার মত শেষদিন। আজ বিকেলে বাংলাদেশী সময় ০৫-৩০ মিনিটে আমাদের বিমান ছাড়বে বাংলাদেশের মাটি। আজ আর বেশী কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে না। আজ আর আমার একার মন খারাপ, তাই নয়, সুমিতা আর ঈশানীরও মন ভারি। খালি মনে হচ্ছে আরও দুটো দিন থেকে গেলে হত।


ইতিমধ্যে সুমিতা কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে মাসুমভাই আর মুনীরভাইকে সঙ্গী করে ঘুরে এল ধানমণ্ডির বাড়ি। ভাগ্যবতী! বইমেলায় মাসুমভাইএর কথা লিখেছিলাম, এবার টক্কর দিলেন মুনীরভাই। শুধুমাত্র সুমিতাকে সঙ্গ দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন বলে, চলে এসেছেন ভয়ংকর অসুস্থ অবস্থায়। সুমিতার মুখে শুনেছি উনি একসময় হাঁটতে পারছিলেন না, দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন। এমনই শারীরিক অবস্থা যে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন নির্ঘাৎ ICU-তে জমা হয়ে যেতেন। তবু তার হৃদয়কে দমাতে পারছিল না তার সুরেলা কন্ঠের মতই উদাত্ত হৃদয়। নিতান্তই অ্যালঝাইমার্সের রুগী না হলে এদের ভোলা যাবে না, ভুলে যাওয়াটাও পাপ। যাই হোক আমার ধানমণ্ডি দেখা হল না এ যাত্রায়। যা যা অধরা, অদেখা রয়ে গেল তার প্রতি আবার আসার প্রতিজ্ঞা দিয়ে রাখলাম। আসলে কিছুতেই পা চলছে না আজ। বেড়াবার ইচ্ছেটাই লোপাট। সকাল থেকেই এক অদ্ভুত মানসিক পীড়নে রয়েছি আমি।  


এ এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। ছেড়ে যেতে মন চাইছে না আবার আমার দেশের মাটি আমায় টানছে। গঙ্গা ডেকে কয় – ফিরে আয় দেশের ছেলে, পদ্মা কাঁদে – আর ক’দিন থেকে গেলে হত না? বিমানবন্দরে যাবার পথে এই লেখাটা লেখার সময় দু চোখ বেয়ে নেমে এলো জল। সে জল আনন্দের না কষ্টের ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারলাম না।


আমায় এপার বাংলা কয় – ওরে দ্যাশের পোলা, এখনও তো এদেশের বাতাসে মিস্যা আছে তোর বাপ পিতে’মোর শ্যাস নিঃশ্বাস। এ তুই ভুলিস ক্যামনে? আমার এপার বাংলা হাঁক দিয়ে বলে – তোমার বৃদ্ধ বাবা-মা তোমারই অপেক্ষায় দিন গুনছে প্রতিনিয়ত। চলে এসো তাড়াতাড়ি, তবে সাবধানে!


হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢুকে যাবার আগে আরেকবার তাকাই। যেন ব্যস্ত সমস্ত রাস্তার ওধারেই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আমার কত জনমের বাবা-মা। মুখে অস্ফুট – আবার আসিস বাপধন, আমরা অপেক্ষায় থাকব, অপেক্ষায় থাকবে আমাগো বারদি, অপেক্ষায় থাকব তরই দ্যাশের মাটি।


পাছে আটকে যায়, তাই জোর করে পা’দুটিকে টেনে নিয়ে চললাম বিমানবন্দরের ভিতরে। বাড়ি ফেরার পথটা ক্রমেই অস্পষ্ট হতে থাকে ঝাপসা চোখের কারনে।



                               সমাপ্ত