(মাননীয়/মাননীয়া কবিবন্ধু তথা পাঠক/পাঠিকার সুবিধার্থে আঞ্চলিক কবিতাটির বাংলা অনুবাদ এবং আঞ্চলিক শব্দের অর্থ যোগ করা হল । বাংলা অনুবাদটি আক্ষরিক অনুবাদ, ভাবানুবাদ নয় তাই কোন কাব্যিক গুন পাওয়া যাবে না । তাই আমার অনুরোধ কেবল আঞ্চলিক ভাষার কবিতাটির উপরই মন্তব্য করুন, অনুবাদের ভিত্তিতে নয়)


আঘন আল্যেই মনটো কেমন যেমন সুরসুরাই
আশক্যা পিঠার ফোঁড়ের পারা ফুলক্যে উঠে,
ধান পাছড়ানোর লাগ্যে হাতগুল্যান নিশপিশায়
নাকে মিঠা বাস আসে লত্যন চালের ভাতের ।


আজ্ঞা, হামি মহুলঘ্যুটার শিরি লফরা বাউরি
বিঘত খানেক বাপুত্যা ডাং-ডহর জমিন ছিল
সকাল-সঞ্ঝা ঘাম-লহু ঢল্যে ধানক্ষেত বনালম
লিজেই কাঁড়া দিয়ে হাল বাঁহে চাষবাস করথি ।
আঘন মাসে আগুনের পারা ধান ঢেলকাঁই দিত
গেরন লাগা চাঁদটোকে, চ্যোখদুটা থিঁরাই যাথ্য
কাঁচা ধানের বাস মনটোকে সরস্যরা রাখথ্য !


নাই কিছু হোক সম্বছরের পেটখুরাকীটো চলথ্য
গোবর ল্যাপা মাটির ঘরে বহু-নুনা-নুনী লিয়ে
ভাদু-টুসু-মকরে মনটো হামার হুঁদক্যে থাকত্য ।
সব ঠিকেই চলথ্য যদি না মটর গাড়ি হাঁকাই
শহর থাক্যে অচানক আমিন এঞ্জীনার আসথ্য ।


সিদিনটো আজ তক্ক পাসুরত্যে নাই পারি বাবু
লকগুল্যা লুহার শিকলী টান্যে হামার সনার পারা
ধানগুল্যাকে দমড়াঁই মচড়াঁই একশা করে দিল ।
হামি গুরগুরাঁই উঠলি - ইটো মগের মুলুক নকি ?
উঁরা বলল্য - মধুকুন্ডায় সিমিট কারখেনা হবেক,
তুর জমিনটো কম্পানি লিবেক, দমে পৈসা পাবি,
ছিল্যাটোর কম্পানির নকরি, সঙে সিমিটের ঘর ।


হাতেপায়ে ধরে বললি - ই জমিনটো হামার মা,
লিবেন নাই বাবু, ভিখ মাঙছি । নাই শুনল্য ।
ই রকম আরও কত লকের জমিন ছিঁনাই লিল ।
বছর ঘুরত্যেই ফুঁকনলের চঙাল্যে ভকভক্যাই ধুঁয়া,
ফুকফুক্যা বিজলি বাতির আল, চকচক্যা পীচকুলি ।
লকে লকে জায়গাটো গিজগিজাঁই গেল, জয়চন্ডীর
চুনাপাথর, দামুদরের জলে সিমিট বনতে লাগল্য ।


মিছা নাই বলব্য বাবু, কম্পানি বহুত পৈসা দিল
ছিল্যাটোকে নকরি, সিমিটের ঘর, বিজলী বাতি ।
তবু মনের খচখচানিটো রহেই গেল, সোপুন দেখি
সনার বন্ন ধানে ঝিকমিকাছে ইধার-উধার-চারধার
পুঁই লতে, মাচার লাওয়ে মাটির ঘরটোর কি বাহার !
আঘ্যনা ধানের ভাতের বাসে বৈলকে উঠে মনটো,
সিমিটের বেড়া উঁখড়াই পাত্যে চায় ধানশীষের ছুঁয়া ।


কিছু আঞ্চলিক শব্দের অর্থ


আঘন (অগ্রহায়ণ মাস); সুরসুরাই (শিহরিত করে); আশক্যা (এক প্রকার চালের পিঠে: ফোঁড়ের (পিঠের গায়ে বায়বীয় উপবৃদ্ধি); ফুলক্যে (ফুলে ওঠে); নিশপিসাই (নিশপিস কর); বাস (গন্ধ); লত্যন (নতুন); বিঘত (বিঘা); ডাং-ডহর (উঁচু-নীচু প্রান্তর); সঞ্ঝা সন্ধ্যা); লহু (রক্ত); ঢেলকাঁই (প্লাবিত করা); গেরন (সূর্য/ চন্দ্র গ্রহণ); থিঁরাই (জুড়িয়ে যাওয়া); সরস্যরা (সতেজ); সম্বছরের (সারা বছরের); বহু-নুনা-নুনী (স্ত্রী-পুত্র-কন্যা); হুঁদক্যে (আনন্দে ভরপুর); অচানক (হঠাত); এঞ্জীনার (ইঞ্জিনীয়ার); পাসুরত্যে (ভুলতে); নকরি (চাকরি); ছিঁনাই (কেড়ে নেওয়া); ফুঁকনলের (চিমনির); চঙাল্যে (নল থেকে); পীচকুলি (পীচ রাস্তা); সোপুন (স্বপ্ন); সনার (সোনার); বন্ন (বর্ণ); আঘ্যনা (অঘ্রহায়ণ মাসের); বৈলকে (চাগিয়ে ওঠা); উঁখড়াই (উপড়ে ফেলে)


অঘ্রানের ধানের ভাত (বাংলা অনুবাদ)


অঘ্রান এলেই মনটা কেন যেন শিহরিত হয়
আশকে পিঠের ফোড়গুলোর মতো ফুলে ওঠে
ধান ঝাড়ার জন্য হাতগুলো নিশপিশ করে
নাকে মিষ্টি গন্ধ আসে নতুন চালের ভাতের


আজ্ঞে আমি মহুলঘুটা গ্রামের শ্রী লফরা বাউরি
বিঘা খানেক পিতৃদত্ত উঁচুনিচু অনাবাদী জমি ছিল
দিনরাত ঘামরক্ত ঝরিয়ে ধানজমি বানিয়েছিলাম
নিজেই বলদ দিয়ে হাল বেয়ে চাষাবাদ করতাম
অঘ্রান মাসে আগুনবর্ণ ধানগুলো যেন উদ্ভাসিত
করতো গ্রহণ লাগা চাঁদকে, চোখ জুড়িয়ে যেত
কাঁচা ধানের গন্ধ মনটাকেও সতেজ রেখে দিত ।


না কিছু হোক সারাবছরের ভাতের জোগাড় হত
গোবর লেপা মাটির ঘরে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে
ভাদু টুসু মকরে মনটা আনন্দে ভরপুর থাকত
সব ঠিকই থাকতো যদি না মটর গাড়ীতে করে
শহর থেকে হঠাত আমিন ইঞ্জিনীয়ার আসতো ।


সেদিনটা আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি বাবু
লোকগুলো লোহার শিকল টেনে আমার সোনা
রঙের ধানগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিল
আমি রেগে বল্লাম – এটা কি মগের মুলুক পেলে
ওরা বল্ল – মধুকুন্ডায় সিমেন্টের কারখানা হবে
তোর জমিটা কোম্পানী নেবে, অনেক টাকা দেবে
ছেলেটার কোম্পানীর চাকরি, সাথে পাকা ঘর ।


হাতেপায়ে ধরে বল্লাম – এই জমিটা আমার মা
নেবেন না বাবু, ভিক্ষা চাইছি । ওরা শুনলো না
পরের বছরই চিমনি থেকে ভকভক করে ধোঁয়া
ঝলমলে বিদ্যুতের আলো, চকচকে পীচের রাস্তা
মানুষের ভীড়ে জায়গাটা গিজগিজ করতে লাগল
জয়চন্ডীর চুনাপাথর, দামোদরের জলে সিমেন্ট হল ।


মিথ্যে বলবোনা বাবু, কোম্পানি অনেক টাকা দিল
ছেলেটার চাকরি, সিমেন্টের ঘর, বিদ্যুতের আলো
তবুও মনের ভিতর একটা আফশোস রয়েই গেল
এখনও স্বপ্ন দেখি সোনা রঙের ধানে সব উজ্জ্বল
পুঁই গাছে, মাচার লাওয়ে মাটির ঘরটা অপরূপ
অঘ্রানের ধানের ভাতের গন্ধে মনটা হয় চঞ্চল
যেন সিমেন্টের বেড়া ভেঙ্গে ধানশীষ ছুঁতে আকুল।