(আজ ২২শে শ্রাবণ, কবিগুরুর মহাপ্রয়াণ দিবস । বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে এক নিরক্ষর আদিবাসী বৃদ্ধের মুখ দিয়ে কুর্মালি ভাষায় শোনা যাক ওর চোখে ২২শে শ্রাবণের তাৎপর্য্য, সাথে সাথে বর্তমান সময়ে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি । প্রসঙ্গতঃ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর বছরে ২২শে শ্রাবণ লিখেছিলাম এবং আমার পছন্দের অন্যতম সেরা কবিতা)


**** মন্তব্য করতে চাইলে দয়া করে সম্পুর্ণ কবিতা পড়বেন ****


শুনলি আজেই ন’কি দাঁঢ়ি ঠাকুর সগ্গ পাঁয়েছিল !
তদের আপিসে কুলুপ দেখে নিবারনকে শুধালি,
বলল্য দাঁঢ়ি ঠাকুরের জনমের সাড়ে সাত কুড়ি
হল্য, তাই লতুন সরকার ছুটি করে দিয়েছ্যে ।
হামার বড় লাতিটো কথাল্যে একটো দাঁঢ়িয়ালা
বুঢ়ার ফট দিয়া ক্যালেন্দার আন্যে টাঙ্গাইছ্যে ।
বলল্য ইটো রভি ঠাকুরের ফট, বহুত শুলুক
লিখেছ্যে, ঝুমুরের পারা বহুত গানও বাঁধেছে ।
হামি ভাবলি হবেক বঠে, দাঁঢ়িটো হঠাঞ দিলে
ঠাকুরের পারাই লাগবেক, দাঁঢ়ি ঠাকুরেই বঠে ।
হামদের গাঁয়ের মদন কুঁহারও ঝুমুর বাঁধথ্য,
পাটির মিটিনে ধামসার সঙে ঝুমুর শুনাথ্য,
ভটের আগেই দুশমনরা উঁকেই টসকাঁঞ দিল
শুনেছি উঁয়ার মরা ফট ছাঁপেছিল প্যাপারে ।


লাতিটোকে শুধাঁইছিলি দাঁঢ়ি ঠাকুরের শুলুকে,
ঝুমুরে হামদের দুখের-ভুখের কথা লিখেছ্যে ?
হামদের জীবনটো’ত রুখাশুখা টাঁড়ের পারাই
বাঁঝা, পিঢ়ির পর পিঢ়ি বিড়ি বাঁধেও নাই
কুছু হল্য, তো শুলুক-ঝুমুর বাঁধেই কি হবেক ?
কিসিমে থাকল্যে বাস্যাম-সুরুপ, নাই’ত ভুখা ।
কত আল্য কত গেল বড়বড় বাতলা করল্য,
বিজলী বাতি হবেক, নুনহীদের ইস্কুল হবেক ।
সঞ্ঝ্যাবেলায় দুরল্যে শহুরের বাতিগুল্যান ভালি
মনটোকে সুঝায় আসবেক, কনদিন আসবেক ।


তা দাঁঢ়ি ঠাকুর হামদের লিয়ে ঝুমুর বাঁধুক
আর নাই বাঁধুক, লকটো ভারী গুনীন ছিল,
মানুষ লয় দেবতা ছিল, হারুমাষ্টর বলছিল ।
ঠিকেই করেছে ঝুমুর বাঁধে মদনার দশাই হত ।
হারুয়েই বলছিল্য ঠাকুরের নকি জগতজড়া নাম !
হ্যাঁ বাবু হামদের গাঁটো কি জগতের বাহারে ?
বলতে শরম লাগে বাবু তবু তুখেই বলে দিছি,
মুঁহে মুঁহে শুলুক হামিও বাঁধি রাত্যে শুয়ে শুয়ে ।
ছেল্যাভুল্যান ছড়া, লিখতে-পড়তে’ত জানি নাই
আশনাই হয় লাতিটোর কাছে বসে টুকু শিখি
বহুটোর ডরে গুঁটাই যাই, নাই বাপ কাজ নাই
বলবেক “যেতনা বুঢ়াছ্যে, ততনা খঁকা হছে” ।
মদনাটো বল্যেছিল, খুঁড়া হামি পঢ়া শিখাঁই দিব ।


এখন ভাবি মদনার কাছে শিখলেই ভাল হত্য
কমসেকম বুঢ়ার শুলুকগুল্যান ত পড়া যাথ্য ।
হামরা চ্যোখ থাকতেও কানা, আঁধারেই রইলি ।
আজ বাইশা শরাভন, ঠাকুরের মরণ তিথি
কতলকে শুনাবেক ঠাকুরের কথা, শুলুক, গান
হামরা সঞ্ঝ্যাবেলায় আশুদতলে বসে বসে ভালব্য,
শহুরের বিজলী বাতিগুল্যা যেমন মিটমিট করে
হামদের বলবেক, টুকু ধীরা, হামি আসে গেছি,
বিজলী লিয়ে, ইস্কুল লিয়ে, দাঁঢ়িঠাকুরকে লিয়ে
তুদের চ্যোখের কালা ঢাক্কনটাকে উঁখড়াই দিতে ।


আঞ্চলিক শব্দের অর্থ
কুলুপ (তালা); শুলুক (শ্লোক বা কবিতা); টসকাঁঞ (হত্যা করা); টাঁড়ের (ধুধু প্রান্তর);
পারা (মতো); বাঁঝা (বন্ধ্যা); পিঢ়ির পর পিঢ়ি (বংশ পরম্পরায়); কিসিমে (ভাগ্যে);
বাস্যাম-সুরুপ (বাসিভাত-কাঁচালঙ্কা); বাতলা (বড় বড় কথা); নুনহীদের (মেয়েদের);
সঞ্ঝ্যাবেলায় (সন্ধ্যেবেলায়); ভালি (তাকিয়ে থাকি); সুঝায় (সান্ত্বনা দিই); মুঁহে (মুখে);
টুকু (সামান্য); ধীরা (ধৈর্য্য ধর); ঢাক্কনটাকে (ঢাকনাটাকে); উঁখড়াই (উপড়ে দেওয়া)