কবিতার পটভুমি : পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল এলাকায় ২০০৬-২০১০ এই রক্তঝরা পাঁচবছরের বীভৎস সন্ত্রাসের সামান্য ঝলক এই কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে । আদিবাসী অধ্যুষিত শান্ত জঙ্গলমহল এলাকাকে অশান্ত করে তুলতে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও ওড়িষ্যা থেকে আগত মতাদর্শ বিচ্যুত তথাকথিত মাওবাদী নেতারা এই এলাকায় মাওবাদী স্কোয়াড তৈরীর উদ্দেশ্যে স্থানীয় যুবক যুবতিদের বলপূর্বক অন্তর্ভুক্ত করতে ঘরে ঘরে সন্ত্রাস কায়েম করেছিল । সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের নিবেদনে একজন পুত্রহারা আদিবাসী বৃদ্ধের গভীর রবীন্দ্রানুরাগের মধ্যেই শুনুন “সন্তাসের তরাস (সন্ত্রাসের ত্রাস)” । একটাই অনুরোধ - দয়া করে সম্পূর্ণ কবিতা পড়েই মন্তব্য করুন ।


নাই বাবু, হামার হারান্যাটো আর নাই ঘুরল্য !


অযুধ্যা পাহাড়ের ই মুঢ়া ল্যে উ মুঢ়া তক
ঝুপ গাজড়ে বহ্ম টাঁড়ে রোজেই তলাশ করি ।
জাগ্যে বসে থাকি রাত্যের বেলি উঁয়ার আশে,
হুলহুল্যা জাড়্যে কুঁকড়াঞ গেলে ভুরসি জ্বলাই
বেল, বড়ফল, মহুল্যা সিঝাই পেটটো ভরাই,
ভাল্যে থাকি কুলহির পানে যদি বেটা আসে !


মা’মরা হারান্যাটো ছিল মুর কলিজার টুকরা,
হামদের সুকুরুটু গাঁয়ের মুহ রাখ্যেছিল বেটা
মেট্টিকে গটা পুরুল্যায় হারান্যাই ছিল জুখেঁ
বাপুত্যা জমিনটো বিকে উঁকে কলিজে দিলি ।
গটা গাঁয়ের লকে বলথ্য উ ছিল্যা লয় হীরা
গরবে হামার ছাতির বেড় হাথীর পারা হথ্য ।


সিবার ধরণের ছুটিয়ে উ মাহিনা তক্ক ছিল্য
দেখলি ভাঙাখাট্যে বসে সুর করে কি পড়ছ্যে
শুধাতেই বলল্য রভি ঠাকুরের দেবতার গেরাস ।
ভগা পিধাঁ বাগদী ঘরের গাঁওয়ার মুখ্যু হামি
বাপের কিরা, কভুও ঠাকুরের নামও শুনি নাই
হারান্যাই বলল্য ঠাকুরের ন’কি জগদজড়া নাম ।


হারান্যার মুহে হুঁই পদ্যটো বেড়ে লাগ্যেছিল বটে
তবে গুমরাঁই গেলি যখন শুনলি মায়ের কোলল্যে
নুনহাটোকে কাড়্যে উঁরা সমুন্দরে ফাবড়াঁই দিলেক ।
ই কেমন বামুনঠাকুর গ, মা কখন কি বল্যেছিল
উটাই মান্যে লিলি ? অন্তরের কথার দাম নাই ?
না, আইজ্ঞা ঠাকুর ই বিচারটো ঠিক করে নাই ।


হারান্যা ছুটিয়ে আল্যে গাঁয়ের যত নুনাহ-নুনহীরা
উঁর ঠ্যাঁরে আসথ্য - ইঞ্জিরি আর হিসাব শিখথ্যে,
হারান্যা বলথ্য - নিখাপড়াই পারে গরিবী হঠাত্যে ।
হামি শুধাঞ্ছিলি - পন্ডিত লক হয়েও রভি ঠাকুর
কেনে গাঁজাখুরি ধম্মবিশ্বাস, মানত টানত মানথেন ?
বেটা জবাব দিথ ঘুমান মানুষকে জাগাবার লাগ্যে ।


সিদিনও জইড়তলে হারান্যা নুনাহ-নুনহীদের পঢ়াচ্ছিল
হামি ঘর ছামুটোয় খাট্যে বসে বসে চুটি টানত্যেছিলি
দুরল্যে দেখলি ভটভটিয়ে আসছ্যে মুহবাঁধা লকগুল্যান
চিল্লাই বেটাকে বললি - হেথা ল্যে ভাগ রে হারান্যা !
হারান্যা সমঝ্যে লিহে তুরন্ত পুয়ালগাদায় সামাঁই গেল
টাঙ্গি বন্দুক লিহে লকগুল্যান হামদের বাখুল্যে ঢুকল্য ।


লম্বুটা হামকে হাঁকড়াই বলল্য - তুর বেটা কুথায় ?
হারান্যাকে হামরা দলে লিব, দুশমন মারত্যে শিখাব্য ।
হামি বললি - নিখাপড়া শিখে হারান্যা মাষ্টর হবেক,
গাঁয়ের লকের আনপঢ় দাগটো মুছে শির উঁচা করবেক
ভুখাদের ভাত যুগাবেক, বেঘরারা লিজের ঘর বসাবেক,
তদের মতন লুচ্চা খুনীরাই হছে হামদের আসলি দুশমন ।


উঁরা হামকে যা লয় তাই বাখান করে বাঁশপিটা করল্য
একটা বন্দুকয়ালা পড়তে আসা ছুটু নুনহী পদীর মাথায়
বন্দুক ঠেঁকাই বলল্য - হারান্যাকে জলদি বাহিরাত্যে বল
নাইল্যে ই নুনহীটোকে’ত মারব্যই, কাউকেই ছাড়ব্য নাই ।
হারন্যা পুয়ালগাদাল্যে বাহিরাঞ আল্য, উঁরা কষে বাঁধল্য
হামার চখ্যের ছামুতে ভটভটিয়ে উঠাঁই উঁকে লিয়ে হাওয়া ।


হেঁই বাবু, রভি ঠাকুরের সেই রাখাল্যা আর হামার হারান্যা
একেই ত হল্য, ন’কি? দুহেঁই ত লককে বাঁচাত্যে বলি হল্য ।
রাখাল্যা গেল মাঝ সমুন্দরে, আর হারান্যাটো সন্তাসের ঘরে
বছর কবে ঘুরে গেল, হামার হারান্যাটো আর নাই ঘুরল্য ।
হারন্যা ঠিকেই বলথ্য - ঠাকুর কভুও মিছা কথা লিখে নাই
উঁর লিখা সেই দেবতার গেরাসই ত আজকে সন্তাসের তরাস ।


শব্দার্থ


ঘুরল্য (ফিরে এল); মুঢ়া (প্রান্ত); তক (পর্যন্ত); ঝুপ গাজড়ে (ঝোপ ঝাড়); বহ্ম টাঁড়ে (নির্জন প্রান্তর); হুলহুল্যা জাড়্যে (তীব্র শীতে); কুঁকড়াঞ (জড়োসড়ো); ভুরসি (শুকনো কাঠ পাতার আগুন); বড়ফল (বট গাছের ফল); মহুল্যা সিঝা (মহুয়া ফল সেদ্ধ); ভাল্যে (তাকিয়ে); কুলহি (রাস্তা); কলিজা (হৃদয়); মুহ (মুখ); পুরুল্যা (পুরুলিয়া জেলা); জুখেঁ (এগিয়ে, শীর্ষে); বেড় (প্রস্থ); পারা (মতো); গেরাস (গ্রাস); ভগা পিধাঁ (অন্নবস্ত্রহীন); বাগদী (নিচু জাতি বিশেষ); বেড়ে (সুন্দর, চমৎকার); গুমরাঁই (শোকস্তব্ধ); নুনহা (বাচ্চা ছেলে); সমুন্দরে (সমূদ্রে); ফাবড়াঁই (ছোঁড়া, নিক্ষেপ); নুনহী (বাচ্চা মেয়ে); ঠ্যাঁরে (নিকটে, কাছে); ইঞ্জিরি (ইংরেজী); হিসাব (গণিত); জইড়তলে (অশ্বত্থ্বতলায়); ছামুটোয় (সামনে); চুটি (পাতা ও তামাকপাতার বিড়ি); ভটভটি (মোটর সাইকেল); চিল্লাই (চিৎকার করে); হেথা (এখানে); ভাগ (পালিয়ে যা); সমঝ্যে (বুঝতে পারা); তুরন্ত (তৎক্ষণাৎ); পুয়াল (খড়); সামাঁই (প্রবেশ করা); বাখুল্যে (বাসস্থানে); হাঁকড়াই (ধমকে); বাখান (গালাগাল); বাঁশপিটা (বাঁশ দিয়ে পেটানো); কষে (শক্ত করে)