কবিতার অন্তরালে : গত ২৩শে নভেম্বর ২০১৪ আমরা হারিয়েছি জঙ্গলমহল তথা বাংলা সাহিত্যের এক বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্ব, জনপ্রিয় কথাশিল্পী, কবি ও ঔপ্যনাসিক অনিল ঘড়াই মহাশয়কে । দুরারোগ্য কিডনী সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন, মাত্র ৫৭ বছর বয়সেই সকলকে কাঁদিয়ে প্রয়াত হলেন । তাঁর আদিভূমি নদীয়া জেলাতে হলেও প্রকৃত কর্মভূমি মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুরেই, পেষায় দক্ষিন পুর্ব রেলের একজন ইঞ্জিনীয়ার । কিন্তু তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি একজন নিবেদিত প্রাণ বাংলা সাহিত্য সেবক । ৩০-৩৫ বছরের সাহিত্য জীবনে শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা, ৭০০ এর বেশী ছোট গল্পের রচয়িতা, এবং অজস্র কবিতা তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছিল । বেশীর ভাগ চরিত্রই উঠে এসেছে সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের হতদরিদ্র মানুষের মধ্য থেকে ।
প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস “নুনবাড়ি”; প্রথম গল্পসংকলন “কাক” । তাঁর অমর সৃষ্টিগুলির মধ্যে “জার্মানের মা”, “লোধাগ্রামে সূর্যোদয়”, “বনবাসী”, জন্মদাগ”, “দৌড়বোগাড়ার উপাখ্যান”, “কামকুঠিয়া”, “অনন্ত দ্রাঘিমা” “নীল দুংখের ছবি” ইত্যাদির কথা বলতেই হয় । এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ । তাঁর অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন “বঙ্কিম পুরস্কার”, “তারাশঙ্কর পুরস্কার”, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, তিস্তা-তোর্ষা পুরস্কার, আকাশ সাহিত্য পুরস্কার, কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার এবং আরও অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি । একটাই দুঃখ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে কোন সফল সাহিত্যিকের সমকক্ষ হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি মফঃস্বল এলাকায় সাহিত্যচর্চ্চার কারনে সেভাবে প্রচারের আলোয় আসেন নি, ফলে যোগ্য মর্যাদাও পাননি ।
কথাসাহিত্যিকের আড়ালে ছিল তাঁর সমাজদরদী ও যথার্থ পরোপকারী এক নির্মল চিত্ত । মানুষ অনিলদা বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক বিরল প্রজাতির ব্যাক্তিত্ব । এত নাম-যশ স্বত্ত্বেও প্রত্যেকেই তাঁর কাছে সমানভাবে গ্রহনীয় । তাই এমন একজন মানুষকে হারিয়ে জঙ্গলমহল এলাকা সত্যিই নিঃস্ব হয়ে পড়লো ।
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই আমার আজকের নিবেদন ।


ধরন দিনে সাঁঝ বিহানে
               পটলা আল্য ঘরে
বলল্য খুঁড়া আসত্যে হবেক
               গপ্ফ পইদ্দের আসরে ।
বললি হামি - হামকে কেনে ?
               থোড়াই পড়ত্যে জানি ?
ভাল লাগে শুনত্যে গপ্ফ
               প্যাঁদলা হল্যেও মানি ।
পটলা ইখন গাঁয়ের মড়ল
               হামকে বড় মানে
ঠেল্যায় চাঁপ্যে হাজির হলি
               গপ্ফ শুনার টানে ।
গাঁয়ের ছুটু ছিল্যা মেয়্যা
               গাইছে তখন গান
এমন সময় আল্যেন উনি
               সভায় আল্য জান ।
পাশেই বসে সেলিম আলি
               বলল্য শুন খুঁড়া
উনি হল্যেন অনিল ঘড়াই
               গপ্ফ লিখায় চূড়া ।
গ্যাঁড়া মতন শ্যামলা গড়ন
               মুহটা বড় মিঠা
ফুলমালা দিয়ে করল্য বরণ
               পটলা শেখের জেঠ্যা ।
শুনলেন বসে গাঁয়ের লকের
               গপ্ফ কবিতা ছড়া
হাততালি দিয়ে উসকে দিলেন
               লতুন নিশান গড়া ।
শুনালেন লিজে পইদ্দ গপ্ফ
               লিজের জীবন কথা
রেলবাবু হয়ে লিখার নেশায়
               যাত্যে হয় হেথাহথা ।
সেলিমের কাছে শুনলি আরও
               মানুষ অনিল ঘড়াই
পকেটের টেকা, মেহনত দিয়ে
               লকের পেরান বাঁচায় ।
মেয়্যার বিহা ছিল্যার ওসুক
               আছেই অনিল দাদা
এত নামডাক মনটা তবুও
               লরম যেমন কাদা ।
শুনলি আজক্যে পটলার কাছে
               অনিল বাবু নাই
ভাল মানুষরা চিরকাল দেখি
               জলদিই চলে যায় ।
গপ্ফের রাজা, থাকবেন তাজা
              মানুষের মন মাঝ
মরণ কখন কাড়ত্যে পারে কি
              রাখ্যে যাওয়া সব কাজ ?


              *****