চলে এলাম লক্ষ্মীরে দেখতে; কেউ জানেনি!
স্বপ্নেও ছিলনা কখনো এমন কোনো কথা;
জানতাম না আমিও,—এভাবেই চলে আসবো হঠাৎ...


আগের চে’ বড় হয়েছে এখন—মুকুলিত আম;
কাটা হয়ে গেছে পাকা ধানগুলো ।
ধানী-জমিতে ক’দিন আগের বৃষ্টি-জলে
হাসেদের জলকেলী, আর ফেটে ফেটে—
উড়ে এসে ভেসে যাচ্ছে শিমুল তুলো ।


ধান-ছাড়ানো কুটোগুলো শুকোতে দে’য়া,
সেই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে পৌছলাম—
লক্ষ্মীর গাঁয়ে; সুপারী পাতার খোলায় বসে,
পুকুরপাড়ে; কাঁচা আমের ভর্তা মাখাচ্ছিল সে;
গরমে গর্ত ছেড়ে আসা সাপটাকে দেখে
তুলে নিলো কী যত্নে; আদুরে ঠোঁট—
ফণা তোলা; ইচ্ছে হচ্ছিলো গুঁজে দিই
লক্ষ্মীর বেণীতে ওই সাপ;—কী সুন্দর, কিন্ত বিষাক্ত!


দেখতে গ্যেছিলাম কীভাবে—চাচীরা-দাদীরা
ধান মাড়াই করে কুলোর বায়ু দিয়ে;
লক্ষ্মীও পারে কীভাবে যেন—কোমরে বাঁধে আঁচল...
এরাই বুঝি বাঙ্গালী-সত্বার আপন “মা”;
আমরা যাঁদেরকে রত্মগর্ভা নামেই চিনি!  
এই প্রচন্ড রোদ; মাথায় নিয়ে—শিসে-গলানো আগুন;
ধান-নিড়ানীর কাজ দেখে চোখ পড়েছিল
কৃষাণী-মেয়ের ‘পর; লক্ষ্মী-ই ফেরালো আমারে!


সফেদার ডালে কাকের বিটকেল-স্বর,
আর শালিকের কন্ঠে সুর—মিলিয়ে লক্ষ্মীর ভেংচি কাটা;
অন্যজীবনের অনুভবনে পৌছে যাচ্ছিলাম আমি ।
পুকুরে, নদীতে—নেমে যাওয়া পানি-স্তর
গরমে যেন ফুটন্ত মনে হয়; পানি ঘোলা করেও
তলেরটুকু একটু ঠান্ডা; সেটাই গোসলের প্রশান্তি,
আর এই সব মানুষেরা গাছের ছায়াতেই—মেনে নেয় পোষ;
ঘরে ভরা—নিদেন গরম; রাত-কাটানোই অসহ্য...


কাঁচা আম কেটে লবণ মাখায়ে দিতে বলেছিলাম লক্ষ্মীরে ।
সে আমার হাতে লবণ—ভরে দিল এক মুঠ;
নিজেই উঠে গেল গাছ বেয়ে—আম পাড়তে;
আয়হায়! লক্ষ্মী লক্ষ্মী করে যারে আমি ডেকে হয়রান,
আমি তো জানতামই-না—সে অভ্যস্ত এমন চঞ্চল-জীবনে;
আমারই ছিল উচিত—আগেই জেনে রাখা!
অন্তত তাল মেলাতে পারতাম...!
ওদিকে সন্ধ্যা নামলো; লিচুতে ধরেনি পাক্;
চাঁদ ফুটলো জামরুলের ফুলের মত!


ধান নিংড়ে রাখা কুটোর গাদায় বসলো সান্ধ্য-আড্ডা;
সারা দিনে ফসল তোলার ক্লান্ত ঘাম, আর কুটোর গন্ধে,
চাঁদনী রাত যেন বাহবা দেয়—আকাশতলে সমাসীনদের!
নারকেল,খই আর চিনির সাথে মুরুব্বী মহিলার চোখ রাঙানী;
মুষড়ে পড়েনি বেগানা লক্ষ্মী; কী দুরন্ত-চঞ্চলা সেই সন্ধ্যা!


সাপ-চিল্লের সুতো কাটাকাটি শেখালো আমারে,
ঘুর্ণী-বাতাসে চুলগুলো বেসামাল—সব বিকেলে,
পান-বরজের ঘুলঘুলিতে পথ হারিয়েছিলাম!
খিলখিল করে হাসে লক্ষ্মী; মজা নেয় আমার সাথে!
কী সব গ্রাম্য অচেনা মানুষদের সাথে আমি!
লক্ষ্মীরে চিনে সবাই; আমারে ভাবে অন্যগ্রহবাসী!


বৈশাখ মাসের কাঁচা কাঁঠালের ইঁচোড় রান্না,
ডুমুর আর কলার মোচা ভূনা;
চিংড়ি মাছ দিয়ে কাঁচা পেপের চচ্চড়ী দিয়ে
গরম ভাত খাইয়ে নিয়ে— নদীর পাড়ে এনে বসায় লক্ষ্মী;
এক দুপুরে হরগোজার ফুল ছিড়তে গিয়ে কাঁটায়—
ছড়ে গেল তার হাত; সেই রক্ত আর ফুল দিয়ে
সুতো ছাড়া গাঁথলো মালা,—হাতের বাঁজু, কানের দুল!
এই-ই-তো আসল অলংকার; সোনা-রুপোর মত হিংসে নেই এতে...
আমি তো বেরিয়েই খুঁজে পেয়েছি নিজেকে!
কই যাবো আর; খেয়ালী লক্ষ্মীরে ছেড়ে...
এই গ্রাম, এই প্রকৃতির দুঃস্থ-রুষ্ঠ যৌবণ,
এখানেই তো জীবনের যত সুর!
কে পারো, পারলে ফেরাও আমারে—এখান থেকে!
আমি—মা’কে চিনেছি আমার; চিনেছি আপনজন!
এখানেই চাই কাটুক—আমার বৃদ্ধি ও যৌবণ!


১৫.০৪.১৬
অজ্ঞাতবাসে