অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ এ জলধি প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল তরুণ কবি ইমামুল মোত্তাকিনের “নপুংসক সময়ের গণতান্ত্রিক ক্ষুধা” নামক কাব্যগ্রন্থ। অগণতান্ত্রিক সময়ে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষুধা বিবেচনা করলে কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। কি আছে এই কাব্যগ্রন্থে? এই রকম ভাবনা থেকেই কবিতার বইটি সংগ্রহ করি। গণতন্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে তরুণ কবি মন এই গ্রন্থ প্রকাশ করতে তাড়িত হয়েছেন কিনা সেই প্রশ্নটিও মাথায় রাখতে চাই। গণতন্ত্র বলতে সাধারণত কোন রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্রের, বিশেষ ক্ষেত্রে কোন সংগঠনের, এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। নির্দিষ্ট সময় ভেদে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দসই নেতা বা নেতৃ নির্বাচনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। হোক সেটি পাঁচ/সাত বছরে একবার বা বহুবার। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় ভোটারবিহীন নির্বাচনকেও গণতন্ত্রের চর্চা বলে আখ্যায়িত করা যায়। এবং সেটি এখন বেশ গ্রহনযোগ্য। সেই বিবেচনায়, মোত্তাকিনের “নপুংসক সময়ের গণতান্ত্রিক ক্ষুধা” বাংলাদেশী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোথায় ঘাটতি সেই প্রশ্নের বাহাজ হাজির করেছেন কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। অথবা তলিয়ে দেখার দাবী রাখে গণতন্ত্রের জন্য কাঙ্গাল “নূর হোসেন”-এর অনুপস্থিতিকেই কি কবি “নপুংসক সময়” বলে উল্লেখ্ করতে চেয়েছেন?
মোট ৬৪ পৃষ্ঠার কলরবে ৫৪টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই গ্রন্থটি। প্রথম কবিতাটির শিরোনাম “শহর ঢাকা আমার” । ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করা তরুণের লেখায় রুপকথার দেবদূতেরা বার বার ধরা দিলেও ঢাকা শহরকে তার কাব্যগ্রন্থে প্রথম স্থান দিয়েছেন। কাক ভরা ঢাকা শহরের গিরগিটি চরিত্রগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। রুপক অর্থে “আলকাতরা হয়ে থাকে মানব মনে” স্থান করে নেয় ঢাকা। কবি লিখে চলেন বদলে যাওয়া সময়ে “কিছু হাহাকারগ্রস্ত কবি চিৎকার করতে পারে শুধু”। এই চিৎকার কিসের জন্য? কবির কাছে উত্তর চাইতে পারি।
“নপুংসক সময়ের গণতান্ত্রিক ক্ষুধা” বাক্যগ্রন্থের সব চেয়ে দীর্ঘতম কবিতার শিরোনাম হচ্ছে “গণতান্ত্রিক প্রিয়তমা”। ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ক্রমবাচক অর্থে কবি তার শিরোনাম নির্ভর কবিতাটি লিপিবদ্ধ করেছেন। “গণতান্ত্রক উপায়ে ভোগ করে মানুষ/কোন কিছুই আর তোমাকে ভাবায় না এখন” উচ্চারণ করে কবি আক্ষেপ করেন। আবার পরক্ষণেই বলে উঠেন, “অসীম স্বাধীনতা মানুষকে অমানুষ করে তোলে”! কবির দোদুল্যমান মানসিকতা ভেসে উঠে কবিতার চরণে চরণে।
বানান বিষয়ে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, জোছনার বাতি না ভাতি, রানি না রাণী? কোনটি হবে জানার আছে। অথবা, হাহাকার নিজেই দুঃখ হলে হাহাকারের পরে দুঃক্ষ রেখে হাহাকারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে তোলা হল কি? “এবং” অনেক বার ব্যবহার করেছেন। প্রথম কবিতায় “এবং আলো”, তৃতীয় কবিতায় “এবং আমাদের”, অন্য আরেকটি কবিতায় “এবং” শব্দের অযাচিত ব্যবহার লক্ষ্য করার মত। এগুলো কি অতিরিক্ত ব্যবহার নাকি ব্যবহারের বাতুলতা? প্রশ্ন রইল।


কিছু কবিতার অংশ বিশেষ মনে দাগ কাটে। “শিশির ছিল অতি ছোট পরিচিত শব্দ” খানিকটা মনে হয় কবিগুরুর “জল পড়ে পাতা নড়ে” কবিতার বিখ্যাত চরণের মত। “অনুভব” নামক কবিতায় “মানুষ আদতে সুন্দর হৃদয় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়” পড়ে মনে হল বাইবেল থেকে কেউ উচ্চারণ করলেন। “এভাবে অপমানি হয়ে বেঁচে থাকা যায় না” শিরোনাম কবিতায় আছে, “নক্ষত্রের মত জ্বলে যাব কিন্তু ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বড় অসময়ে”। কি বিস্ময় জাগানিয়া প্রকাশ! তবে বেশি ভাল লাগার শেষ চরণ হচ্ছে, “আমরা যারা সাধারণ, অসাধারণ চোখে/কবি আর কবিতার খুনসুটি দেখি”। কবিতা নিয়ে কবির খুনসুটি অব্যাহত থাকুক। এই হোক প্রার্থনা।