আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, বিশ্বাস করুন, আমি মোটেও কোনও সাধারণ মানুষ নই। মানে দৃশ্যত আমি স্বাভাবিক সুস্থ একজন মানুষই বৈকি। আমারও আছে দুটো হাত, পা, কান, চোখ, একটা মাথা, নাক, বত্রিশ বা কাছাকাছি সংখ্যার দাঁত ইত্যাদি। যেমন থাকে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের। সবগুলোই দিব্যি কর্মক্ষম। আপাদমস্তক আমি আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ, কিন্তু আমার মধ্যে কিছু বিশেষ অতিমানবীয় ক্ষমতা রয়েছে, যা আর দশজন মানুষের নেই। ইংরাজিতে যাকে 'সুপারন্যাচারাল পাওয়ার' বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এসব কথা আজ অবধি আমি কোথাও প্রকাশ করিনি। ভয় পাই। আমার এইসব অতিমানবীয় ক্ষমতাগুলোর ব্যাপারে লোক জানাজানি হয়ে গেলে, নিশ্চিতরূপেই বিরাট বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হবে। লোকজন সার্কাস দেখার উৎসাহ নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে আসবে আমাকে দেখতে, পেপারওয়ালারা নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত দেবে না, টিভি ক্যামেরার লাইন লেগে যাবে আমার ছোট্ট ঘরখানির সামনে, রাজ্যের গাড়িঘোড়ায় ভরে যাবে পাশের ওই সরু সড়কটি। আমি তখন আর কিছুতেই আমি আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবো না। সবখানে মানুষের নানা রকম অনুভূতিসূচক পলকহীন কালো কালো চোখ গিলে খাবে আমাকে। শিশুরা এখানে সেখানে ছেকে ধরবে ওদের মনোরঞ্জনের জন্য। আরও কতো কীযে হবে! এসব ভেবে আজ অবধি আমি এই ব্যাপারগুলো বেমালুম চেঁপে রেখেছি। কাওকেই জানতে দেইনি। আমার পরিবার পরিজন বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানে না এসব ব্যাপারে। আসলে লোক জানাজানির দারুণ ভয় আমার। কে জানে, পাছে কী থেকে আবার কী হয়ে যায়!
এবার বলছি, কেন আমি ব্যতিক্রম আর দশজনের থেকে। হ্যা, এই যেমন ধরুন দুদিন আগে, রাতের বেলায় হঠাৎ আমার ঘরের ছাদে একটি অদ্ভুত ধরণের কালো রঙের প্রজাপতি এসে বসলো। মাঝরাত তখন। ঘড়ির কাটা দুটো পেরিয়ে গেছে। এ সময় আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম, প্রজাপতিটা বলছে, 'আমার রঙ কালো বলে কেউ আমাকে ভালবাসে না। ফুল পাখি মানুষ, কেউ না!' খুব দুঃখ করে বলছিল কথাগুলো। ভীষণ মিষ্টি একটা নারী কণ্ঠ। আমি কিন্তু ব্যাপারটায় মোটেই অবাক হইনি। এর আগেও বহুবারই এরকম ঘটেছে। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমি পশুপাখি, পোকামাকড়দের কথা দিব্যি বুঝতে পারি। এর কিছুদিন আগেও একবার একটা মাছির কথা পরিষ্কার শুনেছিলাম, আমার চায়ের কাপে এসে চুপটি করে বসেছিল দীর্ঘসময়। আমি মোটেই গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু হঠাৎ উড়ে যাবার আগে বেশ কর্কশ পুরুষ গলায় মৃদু কেশে মাছিটি বললো, 'চা-টা বেশ ভালো লাগলো হে। চমৎকার মিষ্টি হয়েছে।'
সবসময় যে এরকম হয়, তা নয়, হঠাৎ করে, কালেভদ্রে। বেশিরভাগই হয় নির্জনে, একান্তে, মানে আমি আর অপরপক্ষের জীবটি যখন শুধু একত্রে অবস্থান করি, তখন। কয়েকবার অবশ্য ব্যতিক্রমও হয়েছে। তবে তা একেবারেই নগণ্য। এছাড়া পশুপাখি, পোকামাকড়েরা হয়ই মৃদুভাষী। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া তারা কথা বলে না। মানুষের থেকে অন্তত এই একটি ব্যাপারে তারা ঢের এগিয়ে।
আমি প্রজাপতিটার কথা শুনে, আলতো করে বুকে ভর করে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে পৌছে গেলাম ওর কাছে, ছাদে। ইয়ে, হ্যা ঠিকই শুনেছেন, আমি সরীসৃপের মতো বুকে ভর করে হেটেই পৌছুলাম ছাদে। আমি বুকে ভর করে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারি। শুধু তাই নয়, পাখিদের মতো উড়তেও পারি। তবে এই লোকালয়ে উড়বার সুযোগ যে বিন্দুমাত্র হয়ে ওঠে না, সেতো বলাই বাহুল্য। দুধের সাধ ঘোলে মেটাবার মতো মাঝেমাঝে শুধু একাকী ঘরের মধ্যে শূন্যে ভেসে থাকি, ডিগবাজি খাই, উড়ুক্কু ডিস্কো নাচি, কদাচ উড়ে উড়ে চা'টা কফিটা দুধটা চিনিটা আনা নেয়া করি, ইলেক্ট্রিক্যাল কেটলিতে চা-কফি বানাই, পান করি, কখনও কখনও আবার উল্টোদিকে শূন্যে ভেসে থাকি। মাঝেমাঝে আমারও বড্ড সাধ হয়, দিব্যি পাখিদের মতো দিনমান দিগন্তে উড়ে বেড়াবার। কিন্তু পারি না, চারিদিকে এতোসব মানুষের ভিড়! ভয় হয়, আমার বড্ড ভয় হয়, লোক জানাজানির, কেলেঙ্কারির। উফ!
যাই হোক আমি প্রজাপতিটার কাছে যেয়ে বললাম, 'কে বলেছে কেউ তোমাকে ভালবাসে না। এই যে দেখো, আমি তোমাকে ভালবাসি, সত্যি ভালবাসি, হৃদয় দিয়ে ভালবাসি। কণামাত্র কোনও মিথ্যে নেই এতে।' তারপর দেখলাম সেই কালো প্রজাপতিটা ভীষণ আনন্দে আমার চারপাশে কিছুক্ষণ গান গেয়ে গেয়ে উড়ে চললো, আর তারপর এক পর্যায়ে ঠিক আমার তর্জনীর ডগায় এসে বসলো আলতো করে। স্মিত হাসতে লাগলো নিটোল সুখে।
আমি আমার এইসব অতিমানবীয় ক্ষমতাগুলোর ব্যাপারে ইতোপূর্বে কাওকে কোথাও কখনও বলিনি বা প্রকাশও করিনি। এটাই প্রথম।