৯.
পড়ে যেতে যেতে আঁকড়ে ধরে মানব দেহ
এখানেই সভ্যতা জন্মে, এখানেই ধ্বংস বাজে
এখানেই সৃষ্টির আকুল আর্তনাদ,
যার প্রাপ্তি সেই ঢের জানে, এর কী মানে।
আমার কেবলই হারানোর ব্যথা,
পুরনো হাওয়াকে ভেবে ভেবে অনাকাঙ্খিত প্রাণপাত।


রাত নামে, ঘুম নামে, বিছানার পুরোনো আলো
চাঁদ ঝোলে, যেন ঝাড়বাতি, জানালার ওপাশের
অশেষ ঘরে, আসলে আকাশ দেখি,
ল্যাম্পপোস্টের আলোকে তাড়িয়ে, ভরা পূর্ণিমা
অবগুষ্ঠিত গ্যাস লাইটের খুঁটি, দেখি রায় সাহেবের
শেষ দাবার ঘুঁটি অথবা একদা অরুণিমা।


নদীর কুল কুল ঢেউ, দূর পাড়ি বাতাসের শিস
এখানে এই চার দেয়ালের ভিতরে, অগত্যা
বেঁচে থাকি নরকের কীট, অনিশ্চিত সাগরে;
প্রাণ যায় তবু যেন মরে না জীবন,
প্রেম নেই, কোন, অথচ নিয়ত প্রেমের প্রস্রবন,
কতকাল, কত প্রহর, কতসন্ধ্যা-রাত বা দিন
শব্দহীন, মহাকাব্য লেখা, অথবা, পাথরের গায়ে
খট্ খট্ শব্দ তুলে নতুন উপাখ্যানের ভিত রচনা,
জানে না অনন্ত সময়, শুধু ঘৃণা শুধু কান্না,
ভেসে যায় সাগর মহাসাগর, যতিহীন সময়
অথবা বুকের ভিতরে পোড়ে বন, দাবানল,
পেট বাঁচে, পোড়ে দেহ, ঘিরে থাকে কীসের সে ভয়!


ধীরে ধীরে পাল্টায় দেহ, ধীরে ধীরে পাল্টায় ঢেউ,
নদীর বাঁক, তীর, গতিপথ, আমি বাঁচি ভাঙ্গে মহারথ,
থেমে যায় রথের মেলা, যায় বেলা, অবেলা।


একদিন ডাক আসে ভোরে
পাল্কী এসে তুলে নেয় দেহ (মন হীন)
প্রসাদের ভিতরে, সারাক্ষণ সুরে বাঁধা ঘর,
সেই বড় বড় ছায়াতরু ঘেরা, তার ঘর-বাইরে অজস্র পাহারা......
ভিতরে শ্মশানের ঝিঁ ঝিঁ ডাকা নীরবতা!


১০.
তাকে দেখি সেই প্রথম দিনের আলোয়।
সবুজ দীঘির জলে ভাসে নীলপদ্ম পাপড়ি,
দূর পথ ভেঙ্গে আসা হাওয়া
দোল দেয় অপরাজিতার ডালে, নেচে ওঠে ফুলের দেহ
পারিজাতের জটিলতায় মন বিঁধে যায়,
ছিপ ফেলে বসে থাকে সে, চোখ তার গভীর জলে
অতলে, অলকা সুন্দরীর সাথে আলাপচারিতায়।


ধীর পায়ে কাছে এসে বসি, মাপা হাসি
বসনের একটুখানি ধ্বনি, কানে বাজে
ভ্রু কাঁপে, পাশ ফিরে তাকায় এদিক,
ভাষাহীন, নির্বিকার চোখ, আলো ফেলে মুখের উপর।
আমাকে দেখে, কেবলই তাকিয়ে থাকে, যেনো
এ মুখ কখনো দেখেনি সে, এই প্রথম
                  চোখ মেলে দেখা।একা।
যেনো জানতে চায়,‘‘কি নাম তোমার!’’
হয়না জিজ্ঞাসা করা, চোখ ফিরে যায়, নেমে যায়
অনন্ত গভীর জলে, অলকার কাছে।
জলের ভেতর থেকে ডুবুরীর মতো ডুব থেকে
উঠে আসে বুদ্বুদ যেন,‘‘কেমন আছো তুমি?’’


শুনি কী! নাকি বিভ্রম! তার ভাষা কেন বুঝি আমি!
এ ভাষা আমার ভাষা নয়, অপরিচিত সে ধ্বনি
তার হাতে নেই কোন কুঠার কাটুনী
নেই কোন তীক্ষ্ণ ছুরি, বা শান দেয়া ছেনি
অথবা নেই কোন খাপ খোলা তলোয়ার
কিংবা, চাবুক, রশি বা ছড়ি;


তবু ভয়ে শিউরে ওঠে বুক! এ ভাষা নতুন ভাষা,
পুরাতন অতিক্রান্ত শব্দ যেনো আবার জিজ্ঞাসা করে,‘‘ভালো আছো তো!’’


মাথা নাড়ি, নিজের নির্দেশ নয়, কেউ যেনো
বলে দেয় আমাকে, হ্যাঁ বলো, উত্তর এটি।


ছিপ রাখে, উঠে দাঁড়ায় সে, সুঠাম দেহ, পরিপাটি
গোঁফধারী বাবরী চুলের মাথা, ঘণ কৃষ্ণ বন
হাত ধরে, পিঠে হাত রাখে, পুড়ে যায়, স্পর্শিত স্থান
আলগোছে টেনে তোলে দেহ, কোমর সমান।


‘‘এসো’’ সাথে করে নিয়ে চলে, অবিন্যস্ত ধীর পায়ে-
সরুপথ বাগান বিলাস, পারিজাত, বাহারী ফুলের সমারোহ
শির নেড়ে কত কথা কয়, লতা গুল্মের শাখা, তার পাশে
পুকুর-দীঘি, পরিখা, নদীর সংযোগ নালা, সাজানো ঘাটলা,
বেদীমূলে মানবী দেহ, ভঙ্গী দেখি, স্নান ঘাটে বাঁধা।


আমাকে বসায় সে, আলগোছে, পাশে বসে নিজে
দেবদারু নুয়ে পড়ে, স্পর্শ করে পারিজাতের শিরে
সামনে দাঁড়ানো শ্বেত পাথরের নারী-মূর্তি, লনে
স্নান ফেরা তরুণী দেহ, হঠাৎ হাওয়ায় ফসকে যাওয়া
কাঁখের বসন, বিব্রত যেন, সকাশে দেখি অনাকাঙ্খিত
অনাবৃত দেহ, চকিত, নিপূণ বুনন, ভাষা নেই চোখের মাঝে
নিজেকেই কী দেখি নিজের চোখে, অবাক মুগ্ধতায়!
ভুলে থাকি শোক খেদ, কিছুক্ষণ, শৈশব কৈশোর কী এখন
সারাক্ষণ মথিত যে শোকে।


সে আমাকে আবার গড়ে, প্রাণ ছাড়া সবই দেয় তুলে,
যা কিছু একান্ত আমার, ইচ্ছে হয় প্রণাম করি
হোক না সে অন্ধ শিকারী।
তার কিছু চাইবার নেই চিরস্থায়ী, হুইসেল দেয় ট্রেন
সে আমাকে প্রগলভ বলেছে, ‘‘কে তুমি নারী, কোথা থেকে এসেছ বেতস লতা?’’
সে আমার নাম দেয়, ভালবেসে ডাক দেয়,‘‘নাটোরের বনলতা সেন’’।।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//২১ জুলাই ২০১৫; মঙ্গলবার; ০৬ শ্রাবণ ১৪২২//ঢাকার জীবন